কোন পথে চব্বিশের লড়াই, কী ভাবছেন মমতা-পাওয়াররা?
বাণিজ্যনগরী মুম্বাইতে গিয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি ইউপিএ জোটের ভূমিকা নিয়ে সদর্থক প্রশ্ন তুলে দিলেন। কোথায় ইউপিএ জোট? আদৌ আছে নাকি! বিজেপি বিরোধী শক্তির নেতৃত্বে থাকবে কংগ্রেস এবং দেশের সবচেয়ে বৃদ্ধ রাজনৈতিক দলকে নিয়েই অঞ্চলিক ও স্থানীয় ছোট দলগুলিকে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, এ দাবি কংগ্রেস বহুদিন ধরেই করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিজেপি বিরোধী শক্তির অন্যতম দুই কান্ডারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শরদ পাওয়ার তেমনটা মনে করেন না।
একুশের নির্বাচনের পর দেশে প্রধান মোদীবিরোধী শক্তি রূপে উঠে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ত্রিপুরা গোয়া, মেঘালয়, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ একে একে সংগঠন বিস্তার শুরু করেছে ঘাসফুল শিবির। দেশ জুড়ে দিদি হাওয়া বইছে, এমন কি দক্ষিণ ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। মুম্বাইয়ে নাগরিক সমাজের বৈঠকে শিল্পী-কলাকুশলী বিদ্বজ্জনেরা বলেই দিলেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকেই তাঁরা দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। তাঁদের সাফ কথা দেশ এখন মহিলা প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রস্তুত। যদি এ প্রশ্নের উত্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, যে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। কে নেতা হচ্ছেন তা জরুরি নয়, কিন্তু লড়াইটা জরুরি। তিনি সকলকে সুসংবদ্ধ লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন। বাংলায় তৃতীয়বারের জন্য প্রত্যাবর্তনের পরে থেকেই মমতা একথা বলে আসছেন। দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছেন সম্মিলিত লড়াইয়ের আহ্বান নিয়ে। যদিও কংগ্রেসের একে কটাক্ষ করছে কিন্তু সত্যি কী ইউপিএ বলে বর্তমানে দেশে কিছু অবশিষ্ট রয়েছে?
দেশের ছোট বড় সব অঞ্চলিক দলগুলির নিজস্ব আদর্শ রয়েছে। আদৰ্শগত ভাবে সমমনোভাবাপন্ন দলগুলোকে এক ছাতার তলায় আসতেই হবে। তবেই চব্বিশের লড়াই সম্ভব। এই বার্তাই মমতা ও পাওয়ারের বৈঠক থেকে উঠে এসেছে। আজকের জন্য নয়, তাৎক্ষণিক ভবিষ্যতের কথা না ভেবে আগামীতে দেশের নির্বাচনের জন্য বিজেপির বিকল্প হয়ে ওঠা প্রয়োজন। এখন সময়ের আহ্বান, বাধ্যতামূলক ভাবে বিজেপি বিরোধী সমমনোভাবাপন্ন দল গুলিকে এক মঞ্চে আসতে হবে। তাঁদের কথায়, মানুষ তথা দেশের সামনে বিকল্প শক্তিশালী হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে হবে। ২৪-এর বিজেপি বিরোধী লড়াইতে আদৌ কংগ্রেস থাকছে কিনা, বা নেতৃত্ব দেবে কিনা তা অপ্রাসঙ্গিক। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শরদ পাওয়ার স্পষ্টতই জানিয়েছেন, বিজেপি বিরোধী যেকোন দলের জন্যই এই লড়াই উন্মুক্ত। বিজেপি বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে যে কেউ আসতেই পারেন।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, পাওয়ার ও মমতা কংগ্রেস কে সাফ বার্তা দিলেন যে বিজেপি বিরোধী লড়াইতে তাঁদের জন্য পথ খোলা। সেই সঙ্গে এও স্পষ্ট হল বিজেপি বিরোধী যৌথ লড়াইতে এখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের ভূমিকা স্পষ্ট নয়। আদৰ্শগত ভাবে এক এমন সন্মিলিত লড়াইতে কংগ্রেসকে নেতা হিসেবে নয়, সঙ্গী হিসেবে চায় বাকি দলগুলি। এই মর্মে শরদ পাওয়ার আহ্বান, ‘যারা বিজেপির বিরুদ্ধে, তাদের সবাইকে লড়াইতে স্বাগত। কাউকেই আমরা বাদ রাখছি না। বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের এক জোট হয়ে কাজ করতে হবে।’ বলাইবাহুল্য এই একই কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলে আসছেন। মমতাই মোদী মুক্ত ভারতের ডাক দিয়েছেন। জাতীয় রাজনীতির মানচিত্রে ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে তৃণমূল কংগ্রেস।
অন্যদিকে কংগ্রেসের ক্ষয় অব্যাহত, তাদের নেতৃত্ব গলদ রয়েছে। দল পরিচালনাতেও একাধিক সমস্যা থেকে গিয়েছ। বিশেষ করে রাহুল বিরোধী জি-২৩ অর্থাৎ যে ২৩ জন বিদ্রোহী নেতাই প্রমাণ করে যে তাদের দলের অন্দরে সমস্যা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধীদলের ভূমিকা পালনে দলগত ভাবেই কংগ্রেস ব্যর্থ। কিন্তু চব্বিশে লড়াই শুরু সময় আগত, এখন থেকে পুরোদমে বিজেপি মুক্ত ভারতের লড়াই শুরু করতে হবে। এই লড়াইতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা অগ্রণী। বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করাই লড়াইয়ে, যথাযথভাবেই মমতা মুখ হয়ে উঠে আসছেন।
পাওয়ার ও মমতা দুজনের কথাতেই, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই রাজ্যস্তর থেকেই শুরু করতে হবে। ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াই করতে হবে। রাজ্যগুলিতে কোথাও অঞ্চলিক শক্তিগুলিকে, কোথাও কংগ্রেসকে নির্ণায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, গোয়া, মণিপুর যেখানে যেখানে বিজেপি ক্ষমতায়, সেই সব জায়গায় লড়াই করতে হবে। জমি ছাড়লে চলবে না। রাজ্যের দলগুলির এই ছোট ছোট লড়াই ২৪-এ গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথানুযায়ী, রাজ্যে রাজ্যে নিজেদের লড়াইটা যদি অঞ্চলিক দলগুলো সাফল্যের সঙ্গে করতে পারে তবেই মোদী মুক্ত ভারত সম্ভব।
এই লড়াইয়ের ক্যাচ লাইন হবে ‘নো ভোট টু বিজেপি’। তাই এখন বিজেপি বিরোধী জোট গড়তে দফায় দফায় আলাপ আলোচনা করে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই নয় না। প্রতিটি সমমনোভাবপন্ন দলগুলো এক অভিষ্ট লক্ষ্যে নিজেদের লড়াইটা করুক, তবেই বিজেপি মুক্ত দেশ গড়ে উঠবে। বিন্দু বিন্দু দিয়েই সিন্ধু তৈরি হয়, সেই বিশ্বাসের কথাই যেন শোনা গেল বিজেপি বিরোধী দুই নেতৃত্বের গলায়। জোট হল লড়াইয়ের সর্বশেষ ফল এবং তারচেয়েও শেষ ফল হল এই অবিজেপি শক্তির নেতৃত্বে কে থাকবে। রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প। লড়াইয়ের সাফল্যের জন্য সব কিছুকেই স্বাগত, কংগ্রেসও যেমন লড়াইয়ে নেতৃত্বে দিতে পারে, ঠিক তেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নেতৃত্ব দিতে পারেন।
এখন রাজ্যে রাজ্যে অঞ্চলিক দলগুলির বিজেপির শক্তিশালী প্রতিদ্বন্ধি হয়ে ওঠাটা জরুরি। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলতে হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এই লড়াইয়ের কান্ডারী। তাঁর দল যেভাবে জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, তা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করছে যে, আগামীতে বিজেপি বিরোধী শক্তির লড়াইয়ের কেন্দ্রে থাকবেন মমতা ও তাঁর দল। বিজেপি বিরোধী শক্তিদের এক সঙ্গে লড়ার মন্ত্রকে হাতিয়ার করে, সন্মিলিত ভাবে সব অ-বিজেপি রাজনীতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে, তিনিই চব্বিশে বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে চলেছেন।