পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করতে বেলিয়াবেড়ায় বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন শিক্ষকরা
করোনা (Corona) ও লকডাউনের (Lockdown) জেরে প্রত্যন্ত গ্রামের অধিকাংশ পড়ুয়াদের পড়াশোনা কার্যত বন্ধ। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল (School) খুললেও দেখা মিলছে না অনেক পড়ুয়ার। গত ১৫ দিন ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে এহেন চিত্র প্রত্যক্ষ করেছেন ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর ২ নং ব্লকের বেলিয়াবেড়া কৃষ্ণচন্দ্র মেমোরিয়াল হাইস্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক সুব্রত মহাপাত্র। স্কুল ছুটির পর এখন গ্রামে গ্রামে ঢুঁ মারছেন তিনি। আর সেই কাজে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বেলিয়াবেড়া চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক তমাল দাসও।
বেলিয়াবেড়া কৃষ্ণচন্দ্র মেমোরিয়াল হাইস্কুলে নারায়ণপুর, আনন্দপুর, ভান্ডারডিহা, কইমা, ভাদুয়া পড়াসিয়া, পানিপুখুরিয়া, পরশনা প্রভৃতি গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। লকডাউনের কারণে প্রায় দেড় বছর স্কুল বন্ধ থাকার জেরে প্রত্যন্ত গ্রামের অধিকাংশ পড়ুয়া অনলাইনে তেমন পড়াশোনা করতে পারেনি। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস একদিন অন্তর চালু হলেও, পড়ুয়াদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় প্রতিদিন স্কুলে আসার রেওয়াজ ভুলেছে তারা। তার উপর আমন ধানের মরসুমে স্কুল ছেড়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধান কাটতে অনেকেই ব্যস্ত। এমনকী, অনেকে আবার ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েছে রোজগারের আশায়। শুধু তাই নয়, স্কুল বন্ধের সুযোগ নিয়ে নাবালিকা বহু কন্যার বিয়েও দিয়েছে দুঃস্থ পরিবারের বাবা-মায়েরা। যারা এখনও স্কুলমুখী হয়নি, তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পড়ুয়াদের সরকারি সুযোগ-সুবিধার কথা বোঝাচ্ছেন সুব্রত মহাপাত্র। সুব্রত বলেন,’পড়াশোনা করলে পড়ুয়ারা সরকারি প্রকল্প কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, রূপশ্রী, স্কলারশিপ সমেত নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পাবে। সে বিষয়গুলো তাদের পরিবারের সদস্যদের বোঝাচ্ছি। আমার কথায় সাড়া দিয়ে ইতিমধ্যে যারা পড়া ছেড়ে দিয়েছিল, তাদের পাঁচজনকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন অভিভাবকরা।’
পরিসংখ্যান দিয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষক সুব্রত মহাপাত্র বললেন, ‘লকডাউনের সুযোগে নবম শ্রেণির পানিপুখুরিয়া গ্রামের শিউলি দোলাই, মৌসুমি দীক্ষিত, পিউ খামরি, সোনাকড়া গ্রামের মিতালি দোলাই, বৈশাখী সিং, দশম শ্রেণির কইমা গ্রামের সুষমা সিং, পানিপুখুরিয়া গ্রামের নীলিমা সিং, শিপ্রা সিং, পূজা দোলাই, একাদশ শ্রেণির শাঁকরারি গ্রামের অঞ্জু মাইতি মিলে ১০ জনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ভাণ্ডারডিহা গ্রামের সুজিত রানা কলকাতায় ও শুভাশিস রানা হায়দরাবাদে কাজে গিয়েছে।’
কিন্তু গত পনেরো দিন ধরে গ্রামে গ্রামে ঘোরার সুফলও মিলেছে। সুব্রত মহাপাত্র বললেন, ‘নারায়ণপুর গ্রামের রূপসা নাইক, পড়াশিয়া গ্রামের রাসমনি বাগকে একাদশ শ্রেণিতে, পড়াশিয়া গ্রামের রীতা নাইক, পানিপুখুরিয়া গ্রামের ময়না ঘোড়াইকে অষ্টম শ্রেণিতে, পরশনা গ্রামের সোনালি তরাইকে সপ্তম শ্রেণিতে পুনরায় ভর্তি করানো সম্ভব হয়েছে।’
নবম শ্রেণির ছাত্রী রাসমণি বাগ ও রূপসা নাইক বলে, ‘সুব্রত স্যার বাড়িতে এসেছিলেন। পরিবারের সকলকে বুঝিয়ে ফের স্কুলে ভর্তি হতে বললেন। স্যার বলেছেন, সরকারি বই বাদ দিয়ে বাকি বইগুলো কিনে দেবেন। আবার স্কুলে যাব, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে।’ রাসমণির বাবা রামজীবন বাগ বলেন, ‘সুব্রতবাবু বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁর কথা শুনে অনেকেই আবার স্কুলে ভর্তি হয়েছে। মেয়েকেও স্কুলে ভর্তি করলাম। বই কেনার টাকা ছিল না। মাস্টারমশাই বই কিনে দিয়েছেন।’ এই উদ্যোগে সুব্রত মহাপাত্রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বেলিয়াবেড়া চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক তমাল দাস। তমাল দাস বলেন,’করোনার জেরে অনেকেই স্কুলে আসছে না। তাদেরকে ফের স্কুলমুখী করার কাজ শুরু হয়েছে। সুব্রতবাবু স্কুলে পাঁচজনকে ভর্তি করিয়েছেন। খুব ভালো উদ্যোগ। ইতিমধ্যে আমাদের চক্রের মধ্যে ১৫ জনকে পুনরায় স্কুলে ভর্তি করানো সম্ভব হয়েছে। শিক্ষকরা এভাবে এগিয়ে এলে, তবেই স্কুলছুট রোধ করা যাবে।’