দেশ বিভাগে ফিরে যান

“ধর্ম-সংসদের” আড়ালে মুসলমান গণহত্যার ডাক বিজেপি ঘনিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদী নেতাদের

December 23, 2021 | 4 min read

ধর্মের নামে দেশে হিংসা ছড়িয়ে ফের দাঙ্গা লাগিয়ে বিপুল সংখ্যায় মুসলমান হত্যার পরিকল্পনা করছেন বিজেপি ঘনিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদী নেতারা। ধর্মের নামে মানুষকে ব্যস্ত রেখে ক্ষমতা দখলের নেশায় মত্ত বিজেপি। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর একই সুর শোনা যাচ্ছে বিজেপি ও বিজেপিঘনিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদীর গলায়। ধর্ম সংসদের আড়ালে চলল গণহত্যার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা।

বিজেপি শাসনকালে ধর্মীয় বিভেদের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে ভারতবর্ষ। মুসলিমদের বিরুদ্ধে লাগাতার বিষদগার চলছে, নানাভাবে ধর্মীয় হিংসা ও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। এই কাজটি সুচারুভাবে করে যাচ্ছেন বিজেপিঘনিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদী নেতা-নেত্রীরা। সম্প্রতি উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন যৌথভাবে ধর্ম সংসদ নামে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। ১৭ থেকে ১৯শে ডিসেম্বর, তিন দিন ধরে চলা এই অনুষ্ঠান ছিল ধর্মীয় বিদ্বেষের আঁতুরঘর, মুসলমানদের বিরুদ্ধে এখান থেকেই ছাড়ানো হল ঘৃণা ও হিংসা। কার্যত ধর্মীয় হিংসা ছড়ানোর এই আঁতুরঘর থেকেই মুসলিম গণহত্যার ডাক দিল বিজেপিঘনিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদী নেতারা। 

উত্তরাখণ্ডের হিন্দু রক্ষা সেনা নামক একটি সংগঠনের সভাপতি স্বামী প্রবোধানন্দ গিরি, এই ধর্ম সংসদ থেকে কার্যত মুসলিম নিধনের ডাক দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে” কী প্রস্তুতি তাও নিজেই খোলসা করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশকে মুসলিম শূন্য করার প্রস্তুতি নিতে হবে। মায়ানমারের প্রসঙ্গ টেনে, তিনি হিন্দুদের উদ্দেশ্যে নিদান দিয়েছেন, “আর সময় নেই, আর অন্য কোন উপায়ও নেই। হয় মারো, আর না হয় মরে যাও। এখানকার পুলিশ, রাজনৈতক নেতা, সেনাবাহিনী, প্রত্যেক হিন্দুর উচিত হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া এবং মুসলিম সাফাই অভিযান করা।”

এই হিন্দুবাদী নেতার সঙ্গে বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের যথেষ্ট সখ্যতা রয়েছে। এমনকি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গেও তার একাধিক ছবি রয়েছে। জানুয়ারী, ২০১৮ এবং আগস্ট, ২০২০ দু’বার তার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী যোগীর ছবি তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন। একটি ছবি আজও তার ফেসবুক পেজের কভার ফটো। কেবল যোগীই নন, ২০২০-২১ সময়কালের মধ্যে প্রবোধানন্দের সঙ্গে ছবিতে বিজেপির একাধিক নেতা-মন্ত্রীদের দেখা গিয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন, বিজেপি নেতা তথা উত্তরাখণ্ডের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ধন সিংহ রাওয়াত, বিজেপি নেতা নরেশ শর্মা। আবার একটি ছবিতে দেখা গিয়েছে, প্রবোধানন্দের হাতে তরোয়াল তুলে দিচ্ছেন উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তীরাথ সিংহ রাওয়াত। 

তবে প্রবোধানন্দের এটিই প্রথম এমন কাজ নয়, এর আগেও একাধিক বার তিনি মুসলমান বিদ্বেষী মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়েছেন। ২০১৭ সালে তিনি বলেছিলেন, “হিন্দুত্বকে বাঁচাতে হিন্দুদের আটটি করে সন্তানের জন্ম দেওয়া উচিত।” চলতি বছরের জুন মাসে তাকে গণহত্যার প্ররোচনামূলক কথা বলতে শোনা গিয়েছিল। একটি ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছিল, সেখানে তিনি বলছেন, “মানবতাকে বাঁচাতে জেহাদিদের সরিয়ে দিতে হবে। প্রত্যকে মুসলমান বাড়িতে জঙ্গি, জেহাদী রয়েছে। হিন্দুদের উচিত সঙ্গবদ্ধভাবে তাদের সংহার করা।”

ধর্ম সংসদ শেষ হতেই ফের মাথাচাড়া দিয়েছেন নিরঞ্জনী আখড়ার মহা মন্ডলেশ্বর তথা হিন্দুমহাসভার সাধারণ সম্পাদক সাধ্বী অন্নপূর্ণা পূজা সাকুন পান্ডে। হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে, মুসলমানহত্যার সরাসরি ডাক দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ” অস্ত্র ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। মুসলমানদের জনসংখ্যা কমাতে তাদের হত্যা করতে হবে। সবাই তৈরি হও, অস্ত্র নাও খুন করো জেলে যাও। যদি ১০০ হিন্দু অস্ত্র তুলে নেয়, তাহলে কমপক্ষে ২০ লক্ষ মুসলমান মারা যাবে। গডসের মতো হতে হবে।”

ধর্ম সংসদ চলাকালীন বিশালভিউস নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “মেয়েদেরও হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে এবং হিন্দু ধর্মের উপর আঘাত আনছেন তাদের কেটে ফেলতে হবে”।

প্রসঙ্গত, পূজা শাকুনের বিরুদ্ধে এর আগেও ধৰ্মীয় হিংসা ছাড়ানোর একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তবলিগ-ই জামাতের বিরুদ্ধের প্ররোচনামূলক মন্তব্য করে এর আগেও তিনি খবরের শিরোনামে এসেছেন। মুসলমানদের মন্দির চত্বরে প্রবেশ আটকাতে মন্দিরে বেড়া দেওয়ার নিদান দিয়েছিলেন।

এই পূজা শাকুন লেডি গডসে নামেও পরিচিত। সভারকার জয়ন্তীর দিন ছোট ছোট মেয়েদের মধ্যে ছুরি বিতরণ করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। গান্ধীর পুতুল বানিয়ে গডসে জিন্দাবাদ বলে পুতুলে গুলি করে, আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ভিডিও করে ভাইরাল করে হয়েছিলেন। বিজেপি সাংসদ সাধ্বী প্রজ্ঞা এবং মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। নানা সময়ে তার সাথে বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের ছবি দেখা গিয়েছে। তার সঙ্গে বিজেপির একাধিক নেতার যোগাযোগও রয়েছে। আর বিজেপির সঙ্গে এহেন সম্পর্কের কারণেই, বারবার মুসলমান হত্যার কথা বলা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।

আরেক হিন্দুবাদী নেতা স্বামীআনন্দ স্বরূপও একই সুরে সুর মিলিয়েছেন বাকিদের সঙ্গে, তার কথায়, ” ধর্ম সংসদের কথা ভগবানের বেদ বাক্যের মতো, সরকারের তা শোনা উচিত”। নিজের এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে তিনি জানান, “এটা হরিদ্বার! এখানে কোনও মুসলমান ক্রেতা নেই, তাই মুসলমান বিক্রেতাও থাকবে না। মুসলমান দোকানদারদের ছুড়ে ফেলে দিন।”

এর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারীতে আনন্দ স্বরূপ মুসলমানদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে সাংবাদ শিরোনামে এসেছিলেন, সে সময় বলেছিলেন, “হিন্দুদের সঙ্গে থাকতে হলে মুসলমানদের কোরান ও নামাজ পড়া ছাড়তে হবে।” হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “মুসলমানদের থেকে কিছু কিনবেন না, মিশবেন না তাদের সঙ্গে। তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করুন, অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য না করলেই মুসলমানরা ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হবেন।”

আনন্দ স্বরূপ, অ-হিন্দুদের, মুসলমানদের উত্তরাখণ্ডে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি করেছিলেন। তথাকথিত উত্তরাখণ্ডের জমি জেহাদের সময় তিনি উত্তরাখণ্ডের বিজেপি বিধায়ক অজেন্দ্র অজয়ের হয়ে প্রচার করেছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি হিন্দু রাজ্যের দাবি করে আসছেন। এ প্রসঙ্গে বিজেপি বিধায়ক অজেন্দ্র অজয়ের সঙ্গে একটি বেসরকারি সাংবাদমাধ্যম যোগাযোগ করলে বিজেপি বিধায়ক জানান, তিনি আনন্দ স্বরূপকে সমর্থন করেন।

তার কথায়, ” স্বামী আনন্দ স্বরূপকে সমর্থন করার দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত, উত্তরাখণ্ডের সীমান্তবর্তী রাজ্য। তাই জাতীয় সুরক্ষার বিষয় রয়েছে। দ্বিতীয়ত, উত্তরাখণ্ড হিন্দুদের পবিত্রভূমি, কেন শুধুমাত্র হিন্দুদের জন্য একটি পবিত্র জায়গায় থাকবে সে দেশে?” তার কথাতেই স্পষ্ট মুসলমান বিরোধী এসব কাজ বিজেপির মদতেই হচ্ছে। বিজেপি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনীতিতে ধর্মের তাস খেলে চলেছে। বিজেপির ইন্ধন পেয়ে হিন্দুত্ববাদী নেতারাও বিজেপি হয়ে বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন।

এই মুসলমান বিরোধী মনোভাবের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন প্রখ্যাত ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব মার্টিনা নাভারটিলোভা। এই প্রসঙ্গে একটি ভিডিও রিটুইট করে তিনি লেখেন, “কী চলছে এসব!”

সব দেখেও পুলিশ-প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কোন রকম গ্রেপ্তার বা মামলা কিছুই নয়, সবাই মুখে কুলুপ এঁটেছেন। যা প্রমান করে ধর্ম সংসদ এবং এই হিন্ধুত্ববাদী নেতাদের পিছনে বিজেপির প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#bjp, #Haridwar, #Muslim Genocide, #Hindutva Leaders

আরো দেখুন