ফিরে দেখা একুশ: ভাইরাল যা করল কামাল
সৌভিক রাজ
পৃথিবীটা ছোট হতে হতে ড্রইং রুমের বোকাবাক্স ছেড়ে হাতের অ্যান্ড্রয়েডে এসে আটকে গিয়েছে। সোশ্যাল দেওয়ালে চোখ লাগিয়ে বসে থাকি আমরা। নেট দুনিয়ায় কী হচ্ছে, কী চলছে, কী ট্রেন্ড তার দিকেই আমাদের নজর। ভুলে যাই নাওয়া-খাওয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সংক্রমণ যে অনুজীব সংক্রমণের থেকেও মারাত্মক!
পুরো বছর ধরে বাংলা জুড়ে চলল নানান ট্রেন্ড – খেলা হবে থেকে কাঁচা বাদাম। এ বছর বাঙালি যেমন নুসরত-যশের প্রেম নিয়ে মিম বানিয়েছে, তেমন দল বদল নিয়েও দেদার মিম শেয়ার হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আসলে বাঙালির রসবোধ মারাত্মক আর তার সঙ্গে যখন উদ্ভাবনী শক্তি মেশে তখন ম্যাজিক হয়।
এক নজরে দেখে নিই এমন কিছুই ভাইরাল ট্রেন্ড যা করল কামাল, একুশ জুড়ে!
১) খেলা হবে:
একুশ ছিল বাংলার মসনদ দখলের বছর। বাংলার শাসক তৃণমূল কংগ্রেস জন্ম দিল খেলা হবে স্লোগানের। ভোট রাজনীতির ইতিহাসে এতো জনপ্রিয় স্লোগান বোধহয় বাংলা এর আগে দেখেনি। দেবাংশু ভট্টাচার্য গানও বানিয়ে ফেললেন স্লোগান নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের প্রধানমন্ত্রীও এই স্লোগান ব্যবহার করেছেন। বাংলার নির্বাচন মেটার পরে নানা ভাষায় নানা রাজ্যে, “খেলা হবে”-র অনুবাদ হয়েছে। বাংলার দুর্গা পুজো থেকে সরস্বতী পুজো, ভাসানের নাচ থেকে পিকনিক সর্বত্র এই স্লোগান বেজেছে। গোটা নির্বাচন পর্ব জুড়ে এই গান দাপিয়ে বেরিয়েছে বাংলায়। আজও এর জনপ্রিয়তায় বিন্দু মাত্র ভাটা পড়েনি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৬ই আগস্ট দিনটিকে খেলা হবে দিবস হিসেবে পালন করতেও শুরু করেছে।
২) তোকে নিয়ে ব্রিগেড যাবো টুম্পা:
এও নির্বাচন পর্বে ভাইরাল হওয়া গান। ২০২০ সালের জনপ্রিয় গান টুম্পাকে নিয়ে প্যারোডি বানিয়ে ছিল বামেরা। গান মানুষের সোশ্যাল ওয়ালে ওয়ালে ঘুরলেও, ভোট আনতে পারেনি বামেরা। এই সব গানের রাজনীতি দেখে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছিল বিজেপি কিন্তু তাদের গান মুখ থুবড়ে পড়ে। বরং তাদের নেতাদের বিকৃত বাংলা উচ্চারণ বেশ কয়েক দফা ভাইরাল হয়েছে।
৩) দামোদর শেঠদের ভোজ:
বাংলার মানুষের মন পেতে, সাধারণ মানুষের বাড়ি বাড়ি পঞ্চব্যাঞ্জনে আহার সারতে যেতেন বিজেপি নেতারা। মানুষ এই ভোজ নিয়ে দেদার মিম বানিয়েছে। বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন বাংলার ক্রিয়েটাররা।
৪) দামে কম মানে ভাল কাকলি ফার্নিচার:
ভোট মিটতে না মিটতেই নেটদুনিয়ায় কাঁপুনি ধরালো, কাকলি ফার্নিচার। ওপার বাংলার এক আসবাবের দোকানের বিজ্ঞাপন রাজত্ব করল এই বাংলায়। এমন কী দোকানের কর্তৃপক্ষ জানাল তারা কলকাতাতেও শাখা খুলবে। ভাবুন ভাইরালের মহিমা!
৫) শোভন-বৈশাখী:
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা মিমারদের শোভন-বৈশাখী ভরসা। এরা সারা বছর খবরের শিরোনামে থাকেন। রং মিলান্তি থেকে ফেসবুকে নাম বদল। সম্পত্তি হস্তান্তর থেকে রত্নাকে নোটিশ – বছর জুড়ে নানান সময় শিরোনামে থেকেছেন দুজনে। তবে ২১-এর পুজোর সময় শোভন বৈশাখী ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দুতে। প্রাক পুজো সময়ে নিত্য নতুন সাজ পোশাকে সেজে মাতিয়ে রেখেছিলেন নেট দুনিয়া। ময়দান-ঘোড়ার গাড়ি- ভিক্টরিয়া সব কিছু তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছে সবাই। বাংলার সব প্রথম সারির মিডিয়ারা পড়েছিল তাদের ফ্যাশান ট্রেন্ড নিয়ে!
৬) বুর্জ খলিফা:
২১-এর দুর্গা পুজো মানেই ছিল বুর্জ খলিফা। শ্রীভূমি যেন এক একটুরো বুর্জ খলিফা নামিয়ে এনেছিল। গোটা রাজ্যের মানুষ উপচে পড়েছিল সেখানে, অন্তত কয়েক কোটি রিলস হয়েছে ম্যানু বুর্জ খলিফা গানে। কেবল দুর্গা পুজো হয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারপর কালী পুজো,জগদ্ধাত্রী পুজোয় সারা বাংলায় নানা প্রান্তে বুর্জ খলিফার আদলে প্যান্ডেল করা হয়। ক্ষীরের মিষ্টিও তৈরি হয়েছে বুর্জ খলিফার অনুকরণে। এবার পুজোয় বুর্জ খলিফা বাংলার সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছে।
৭) কাঁচা বাদাম:
বছরের শেষ লগ্নে ভাইরাল হয়েছে কাঁচা বাদাম। জটায়ুর ভাষায় বলতে হয়, বাংলার মিম রাজ্যে হট কচুরিজের মতো বিকোচ্ছে এই গান। লাল মাটির দেশের ভুবন বাবু গ্রামের নানান জায়গায় এই গান গেয়ে বাদাম ফেরি করে বেড়াতেন। সেই গানই এখন রাজ্য জুড়ে ভাইরাল। কন্টেন্ট ক্রিয়েটাররা সব ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ইউটিউবারদের চাপে তার প্রাণ ওষ্ঠগত। দেশ পেরিয়ে বাংলাদেশও বাদাম জ্বরে আক্রান্ত। কলকাতার পুরভোটেও এই গান গেয়ে প্রচার করে গিয়েছে বাদাম দাদা। আবার কাঁচা বাদাম গানের প্যারোডি ভাজা বাদামও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
৮) বচপন কা পেয়ার:
জানে মেরি জানে মন বচপন কা পেয়ার মেরা ভুল নেহি জানা রে। একটি স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা গাইছে, এইভাবেই সামনে এসেছিল একটি ভিডিও। বাকিটা ইতিহাস! অল্প কদিনের মধ্যেই দেশ জুড়ে ভাইরাল হয়ে যায় ছেলেটির কণ্ঠ। নানা অনুষ্ঠানে দেখা যেতে শুরু হয় তাকে, দেশের প্রথম সারির সংগীত শিল্পীরা রেকর্ড করে ফেলেন তার সঙ্গে, আসলে ট্রেন্ডের মহিমা এমনই। কিছু শুরু হলেও সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
৯) শ্রীময়ী-রোহিত সেন:
বহুদিন হল সিরিয়ালের কুটকাচালি পর্দা পেরিয়ে আমাদের বাড়িতেও ঢুকে এসেছে। ধারাবাহিকে তো অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসের সন্ধান মেলে, উল্টো হাতে ব্যাট ধরেই কেউ সেঞ্চুরি করছে, প্লেনে উঠেই কেউ প্লেন চালাচ্ছে, ঠিক তেমনই বাংলার ঘরে ঘরে ঢুকে গিয়েছে অনিন্দ্য দা, শ্রীময়ী, রোহিত সেন এবং জুন আন্টি। টেলিভিশনের জিনিসকে বাস্তব ভেবে লোকে হামলে পড়ছে। শ্রীময়ীর দুঃখে লোক কাঁদছে, জুন আন্টিকে গাল দিচ্ছে, জুন আন্টির জেল হলে মজা পাচ্ছে দর্শক, কী লেভের জনপ্রিয়তা! সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে মিমের বন্যা বয়ে যায় শ্রীময়ী-রোহিত-জুন আন্টি এই ত্রয়ীকে নিয়ে, এরাও মিম মানচিত্রে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন।
১০) মদন মিত্র:
তিনি নিজেই একটা প্যাকেজ। রঙিন মানুষ যা করবেন তাই ভাইরাল। ওহ লাভালি থেকে মোদী-অমিত শাহ কুমড়োর ঘ্যাট খা, এম এম ইস এ কালারফুল বয় থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত, সবেতেই তিনি হিট। মদন মিত্র লাইভে আছি বললেই, লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের ঝড় শুরু হয়ে যায়। কোটি কোটি ভিউ, অভিনেতা থেকে নেতা তার প্রোফাইলের রিচ দেখলেই সকলেই ঈর্ষা করবেন। মদন মিত্রই বোধহয় বলতে পারেন, যে কোন ভূমিকায় সমানে লড়ে যাই আপনি যা চান আমি ঠিক তাই।
১১) দলবদলের হিড়িক:
এ বছর বাঙালি যেমন নুসরত-যশের প্রেম নিয়ে মিম বানিয়েছে, তেমন নির্বাচনের সময় দলবদল নিয়েও দেদার মিম শেয়ার হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। নেতা-নেত্রীদের টুইটও হয়েছে ভাইরাল। দলবদলু নেতাদের কটাক্ষ করতে মিম হয়েছে ভাইরাল, মুকুল-রাজীবের ঘরে ফেরা থেকে শুরু করে শুভেন্দু অধিকারী, বাদ পড়েননি কেউই! কারোর খাতাতেই মিমের সংখ্যা কম নয়। অভিনেতা যশ আর ঘূর্ণিঝড় ইয়াসকে মিলিয়ে মিশিয়েও মিম বানিয়েছে রসিক বাঙালি।
১২) ভাইরাল যখন ভাইরাস বধের হাতিয়ার:
নেট দুনিয়া কেবল বিনোদনের বস্তু নয়! সে কেবল সময় অপচয় করে না। বরং বাঁচার মন্ত্র শেখায় সে। এবার ভাইরালের সুবিধা পেয়েছেন বহু মানুষ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় বহু মানুষ অন্য মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন নেট মাধ্যম। সরকার, সুশীল সমাজ আর মানুষের প্রয়াসে জয়ী হয়েছে মানবতা।