মানিক পুত্রের লেন্সে পুলুদা
সৌভিক রাজ
সত্যজিতের অপুর সংসার ছবি থেকেই রুপোলি পর্দার যাত্রা শুরু করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মানিকের ৩৪টি ছবির মধ্যে ১৪ টিরই নায়ক তিনি। পরিচালক ও অভিনেতার যুগলবন্দীর এক অনন্য রসায়নে অপার মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে পর্দায়। বাঙালি দর্শক পেয়েছে একের পর এক কালজয়ী ছবি, অভিযান, অশনি সংকেত, গণশত্রু… কিন্তু সত্যজিৎ চলে যাওয়ার পরেও তার গল্পে অভিনয় করেছেন মৌমিত্র, পরিচলকের ভূমিকায় ছিলেন সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায়। পুত্রের লেন্সের সামনে কেমন করে অভিনয় করলেন মানিকের মানসপুত্র, আসুন দেখে নেওয়া যাক।
১) উত্তরণ :
ছবিটি সত্যজিৎ রায়েরই পরিচালনা করার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯৯২-এর এপ্রিলে তিনি মারা যান। ছবি গল্প এবং চিত্রনাট্যটি তাঁরই। ছবিটি পরিচালনা করেন সন্দীপ, উত্তরণ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে।
সত্যজিতের শেষের দিকের কাজ এই চিত্রনাট্যটি, তার আগে বানিয়ে ফেলেছেন গণশত্রু, আগন্তুক। তখন নব্বই দশক ও সমকালীন ভারতবর্ষ বারবার সত্যজিতের ছবিতে উঠে আসছিল। ধর্মের বাড়বাড়ন্তের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছিলেন মানিক।
এই ছবিতে শহরের এক বিখ্যাত ডাক্তারের ভূমিকায় অবতীর্ন হলেন সৌমিত্র। যাওয়ার পথে এক গন্ডগ্রামে আটকে পড়েন চিকিৎসক সৌমিত্র। সেই গ্রামে এক বৃদ্ধ মুমুর্ষরোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ওঝা ডেকে ঝাড়ফুক করা হচ্ছিল। বৃদ্ধ রোগীটির মেয়ে নিরুপায়। গ্রামীণ নিয়মের কাছে তার হাত পা বাঁধা। বিংশ শতাব্দীর প্রান্তে দাঁড়িয়ে এই অন্ধবিশ্বাসের বেসাতি আর সহ্য করতে পারেননি সৌমিত্র। তিনি চিকিৎসক, তন্ত্রে-মন্ত্রের মাধ্যমে রোগ সারানোর নামে রোগীকে অত্যাচার করা আর সহ্য হয়না তাঁর। রোগীকে বাঁচাতে ছুটে আসেন, গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে রোগীকে উদ্ধার করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়না।
একদিকে ভারত মহাকাশযান পাঠাচ্ছে আর অন্যদিকে সেই ভারতের গ্রামে এখনও ওঝার ভরসায় বাঁচতে হয় মানুষকে, তদানিন্তন রাষ্ট্রযন্ত্রকে যেন সেই প্রশ্নই করেছে উত্তরণ ছবিটি। ছবি অন্য ভূমিকাগুলিতে শুভেন্দু চট্টপাধ্যায় এবং শুভমিতা অভিনয় করেন। ছবির দৃশ্যধারণ হয় ইন্দাস গ্রামে, অসামান্য অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছবিটি জাতীয় পুরস্কার জিতে নেয়।
২) অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য :
ফেলু গল্পেও অভিনয় করেছেন সৌমিত্র, কিন্তু ফেলু চরিত্রে নয়!
সত্যজিতের ফেলু কাহিনীগুলির মধ্যে থেকে কিছু কাহিনী নিয়ে টেলিছবি নির্মাণ করেন সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ। তার মধ্যে একটি হল অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য। যা সত্যজিতের গপ্পো টেলিভিশন সিরিজের অধীনে নির্মাণ করা হয়। এই গল্পে ফেলু তোপসে এবং জটায়ুর ভূমিকায় যথাক্রমে সব্যসাচী চট্টপাধ্যায়, শাশ্বত এবং বিভূত ভট্টাচার্য অভিনয় করেছিলেন। এই গল্পের অন্যতম মুখ্য চরিত্র অম্বর সেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন সৌমিত্র। ফেলুকে জব্দ করতে অম্বর সেন নিজেই আত্মগোপন করেন। তাতেই বাঁধে অন্য এক বিপত্তি কিন্তু সবশেষে ফেলুর মগজাস্ত্রের কাছে অম্বর সেনের সব কায়দা কানুন ধরা পরে যায়। সন্দীপ রায় পরিচালিত এই একটিইমাত্র ফেলু কাহিনীতেই অভিনয় করেন সৌমিত্র। যদিও শোনা যায় সিনেমায় সিধু জ্যাঠার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সৌমিত্র বাবুকে একবার অনুরোধ করেছিলেন সন্দীপ, কিন্তু তিনি রাজি হননি।
৩) জুটি :
ফেলু-শঙ্কুর পাশাপাশি, সত্যজিতের কলমের এক অনবদ্য সৃষ্টি হল তারিণী খুড়ো। সেই গপ্পো বলা খুড়োকে নিয়ে ছোটপর্দা ও বড়পর্দা মিলিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন পরিচালক সন্দীপ। সত্যজিতের গপ্পো টেলিভিশন সিরিজের মধ্যে তারিণী খুড়োর একটি গল্পে অভিনেতা সৌমিত্রের দেখা মিলেছে। গল্পের নাম জুটি। গল্পটা সত্তরের দশকের, সৌমিত্র এখানে অভিনেতার চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাঁর নাম রতন লাল রক্ষিত। তারিণী খুড়ো যৌবন বয়সে কিছুদিন রতন লাল রক্ষিতের বাড়িতে তাঁর সেক্রেটারির চাকরি করেছিলেন।
রতন লাল টকিজ ছাড়াও নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগের এক মহাতারকা, তিনি নির্বাক যুগে বিশু-শিবু নামে একটি সিরিজে অভিনয় করতেন। লরেন হার্দির অনুপ্রেরণায় এই সিরিজ সৃষ্টি হয়েছিল। বিশুর পার্ট করতেন সৌমিত্র নিজে অর্থাৎ রতন লাল রক্ষিত এবং শিবুর পার্ট করতেন তাঁর বন্ধু শরৎ কুন্ডু। শরৎ কুন্ডুর কণ্ঠস্বর ভাল ছিল না। নির্বাক যুগের পরে চলচ্চিত্র সবাক হলে তিনি হারিয়ে যান। বন্ধু বিচ্ছেদ হয়। সেক্রেটারির কাজের পাশাপাশি এই বিশুর হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটিকে খুঁজে বের করার ভার পড়ে তারিণীর উপর। শেষটায় দেখা যায় অভাবের তাড়নায় শিবু বন্ধুর বাড়িতেই অর্থাৎ রতন লাল রক্ষিতের বাড়িতেই চাকরের কাজ করছেন। দুই বন্ধুর দেখা হয় যায়, ভেঙে যাওয়া জুটি ফের গড়ে ওঠে।
১৯৯৯ সালে সন্দীপ রায় সত্যজিতের গপ্পো টেলিভিশন সিরিজটি পরিচালনা করেন। সর্বমোট ১৪ টি গল্প নিয়ে কাজ হয়। যার দুটিতে আমরা অভিনেতা হিসেবে সত্যজিতের মানিকপুত্রকে পেয়েছি।
৪) নিশিযাপন :
ফের মানিক পুত্র আর মানস-পুত্রের যুগলবন্দী। পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি ২০০৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল। কাহিনীকার ছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। নিশিযাপন নামে তাঁর একটি উপন্যাস অবলম্বনেই এই ছবি হয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন দীপঙ্কর দে, সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং রাইমা সেন।
সৌমিত্র তাঁর নিঃসঙ্গ বার্ধ্যক্য যাপন করেন প্রকৃতির নিবিড় কোলে পাহাড়ে কাছে তিনি বার্ধ্যকের বারানসী গড়ে তুলেছেন। তাঁর ছেলেরা সুপ্রতিষ্ঠিত, তারা বাবার সঙ্গে ছুটিতে দেখা করতে আসেন। হাসি মজার ছলে ছবি এগোয়। হঠাৎ করেই এক রাতের ভূমিকম্প আর সভ্যতা এবং গোটা পৃথিবীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একমাত্র ব্রিজটি ভেঙে যায়। খাদ্য সংকট শুরু হয়, দুদিনেই মেকি সামাজিকতা আর প্রতিষ্ঠিত জীবনের কঙ্কাল বেরিয়ে আসে। সংকটেই মানুষ চেনা এ যে অমোঘ সত্যি তা উপলব্ধি করা যায় এই ছবিতে, আদপে আনুষ্ঠানিকতা নয় সহজ সরল জীবনই বেঁচে থাকার জন্য একান্ত প্রয়োজন তাও উপলব্ধি করিয়েছেন ছবির নির্মাতা। জীবনকে এক পৃথক আঙ্গিকে চেনাবে এ ছবি।