দেশনায়কের জন্মদিনে আজ ষাট বছর ধরে কলকাতাকে বিনামূল্যে তেলেভাজা খাওয়াচ্ছে সাউপরিবার
সৌভিক রাজ
বাঙালিকে ব্যাখ্যা করতে খাবারের চেয়ে ভাল উদাহরণ বোধকরি আর কিছু হয়না। দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রের খাদ্যপ্রেমী সর্বজনবিদিত। ঘরোয়া খাবার ছাড়াও তাঁর অন্যতম প্রিয় খাবার ছিল তেলেভাজা। উত্তর কলকাতা হল তেলেভাজার স্বর্গরাজ্য, সেই খাস উত্তর কলকাতার লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের দোকানের তেলেভাজার প্রেমে পড়েছিলেন নেতাজি। আজও এ দোকান বাঙালির রসনাতৃপ্তি ঘটিয়ে চলেছে। হাতিবাগান থেকে হেদুয়ার দিকে এগিয়ে চলেছেন ডান হাতে পড়বে এই দোকান। রকমারি চপের গন্ধে আপনার জিভের স্বাদ কোরকগুলো স্বাস্থ্যের চিন্তাকে বাপি বাড়ি যা করে দেবে। মস্তিষ্ক বলবে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। আজ থেকে একশো চার বছর আগে পথ চলা শুরু করেছিল দোকানটি।
সময়টা ১৯১৮, গয়া থেকে কলকাতায় পা রাখলেন খেঁদু সাউ। উত্তর কলকাতায় স্টার থিয়েটার থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে তেলেভাজার দোকান দিলেন৷ দোকান না বলে গুমটি বলাই শ্রেয়। ওদিকে এআইসিসি-র কর্ণধার নিযুক্ত হচ্ছেন সুভাষ।
ওদিকে জমে উঠেছে খেঁদু সাউয়ের কারবার। পিঁয়াজি, বেগুনি, কাশ্মীরি চপের গন্ধে মম করছে এলাকা। সাবেক বাঙালি চপের স্বাদে মজেছে। খেঁদু সাউ নিজেই খুন্তি হাতে নেমে পড়তেন চপের পুর বানাতে, তার রন্ধনের গুণে বাঁধা পড়ল উত্তর কলকাতার মানুষ। লোকমুখে দোকানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশ সময় লাগেনি। ক্রমশ দোকানের খ্যাতি যখন ছড়িয়ে পড়ত শুরু করল তখন খেঁদু সাউ ছেলের নামে দোকানের নাম রাখলেন ‘লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ অ্যান্ড সন্স’। দোকানে ভিড় বাড়তে লাগল, ছাত্রবস্থায় সেখানে নেতাজিও যেতেন। যদিও তখনও তিনি সুভাষ চন্দ্র বোস। লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ-এর নাতি মোহন কুমার গুপ্ত কথানুযায়ী, ‘নেতাজী যখন স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়তেন তখন বন্ধুদের সঙ্গে আসতেন এই দোকানে। চলত আড্ডা, বিপ্লবের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা। আমার দাদু স্বদেশীর গোপন চিঠিও হাতবদল করেছিলেন ছিলেন কয়েকবার’। শোনা যায় এই দোকান থেকেই বিপ্লবীদের বহু গুপ্ত ঠেকে চপমুড়ি যেত। দোকানের আশপাশে তখন স্বদেশীদের মিটিং চলত। মিটিংয়ের মুড়ি, তেলেভাজার বরাত পেতেন খেঁদু সাউ। তেমনই একটি মিটিংয়ে তাঁর সঙ্গে স্বয়ং নেতাজির সাক্ষাৎ হয়। খেঁদুর হাতের বানানো চপ খেয়ে নেতাজি মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে উত্তর কলকাতায় নেতাজির সভা থাকলেই, আলোচনার সঙ্গে খেঁদুর হাতের চাপ মাস্ট। দেশনায়ককে দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন খেঁদু, নেতাজীর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে স্বদেশিদের পত্রবাহকও হয়েছিলেন তিনি। খেঁদু নিজেও জড়িয়ে পড়লেন স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে। গোপন তথ্য বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব নিলেন খেঁদুবাবু। বিপ্লবীদের তথ্য চালানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে উঠল খেঁদু সাউয়ের দোকান। ততদিনে স্বদেশী আন্দোলনের আখড়ায় পরিণত হয়ে গেছে এই দোকান। সেই সময় শালপাতায় ঠোঙায় তেলেভাজা পরিবেশন করা হত। শালপাতাতেই স্বাধীনতা সংগ্রামের তথ্য চালাচালি হত। স্বদেশী আন্দোলনে সাহায্য করার জন্যে খেঁদু সাউকে দু’বার কারাগারেও যেতে হয়েছে। ১৯৪২ সাল থেকে প্রতি বছর নেতাজির জন্মদিনে বিনে পয়সায় শহরবাসীদের চপ বিলি করতে শুরু করলেন খেঁদু সাউ। প্রত্যেক বছর ২৩ জানুয়ারি সকাল হলেই পরিচিত মহল, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে নেতাজির গুণকীর্তন করতে করতে চপ, ফুলুরি, পিঁয়াজি বিতরণ করতে শুরু করতেন। স্বাধীনতা পাওয়ার পরের বছরে দোকানটির আধুনিকীকরণ করা হয়, সেই সঙ্গে চপ বিলির ধরণে বদল আনা হল। তখন থেকে নেতাজির জন্মদিনে দোকান থেকেই কচিকাঁচাদের জন্য দুটো এবং বড়দের জন্য চারটে করে তেলেভাজা বিতরণ শুরু হল। আজও তা একইভাবে চলে আসছে।
প্রতিবছর ২৩শে জানুয়ারি সকাল সাতটা থেকে দুপুর তিনটে পর্যন্ত তেলেভাজা বিতরণ চলে। দোকানের সাইনবোর্ডেও জ্বলজ্বল করে নেতাজির ছবি। চারপুরুষ ধরে দোকান চালিয়ে আসছেন লক্ষ্মীনারায়ণের পরিবার, বর্তমানে উত্তর কলকাতার সুবিখ্যাত এবং ঐতিহ্যবাহী এই দোকান সামলাচ্ছেন কেষ্টকুমার গুপ্তা। ঐতিহ্য এবং জনপ্রিয়তা বজায় রেখেই চলছে লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের তেলেভাজা। চিরাচরিত আলুর চপ, কাশ্মীরি চপ, বেগুনি, ধোঁকা ইত্যাদির সঙ্গে আমের চপ, পনিরের চপ, চাউমিনের চপের মতো অভিনব পদের আবির্ভাব হয়েছে।