শিখর ছুঁয়ে ফেলে এবার নিম্নমুখী রাজ্যে করোনা সংক্রমণ, মত স্বাস্থ্য মহলের
নতুন বছরের শুরু থেকেই করোনার লেখচিত্র ছিল উর্দ্ধমুখী। কলকাতা-সহ বেশ কিছু জেলায় ‘রকেট গতিতে’ বাড়ছিল করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। বছরের প্রথম মাস ফুরনোর আগেই তেমনই এখন দ্রুত গতিতে কমছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। এমনই মনে করছেন চিকিৎসকরা। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী দাবি করেছেন, ‘‘রাজ্যে করোনার সংক্রমণ শিখর ছুঁয়ে ফেলেছে। চলতি করোনা স্ফীতিতে আর দৈনিক ২২ বা ২৩ হাজার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’’
করোনা আক্রান্তের সংখ্যার বিচারে ৯ জানুয়ারি রেকর্ড গড়লেও ১০ জানুয়ারি রাজ্যে সংক্রমণের হার ছিল বেশি। অন্যদিকে, কলকাতা বা দক্ষিণ ২৪ পরগনা-সহ শহরতলিতে করোনা আক্রান্তের লেখচিত্র নিম্নগামী হলেও দার্জিলিং, কালিম্পং-সহ উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার সংক্রমণের চিত্র এখনও ‘স্বস্তিদায়ক’ নয়।
১১ থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা ২০ হাজারের ঘরে ছিল রাজ্যে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। তার পর থেকে রাজ্যে সংক্রমিতের সংখ্যা কমতে থাকে। সেই নিম্নমুখী ধারা এখনও অব্যাহত। সংক্রমণের পরিসংখ্যানের এই প্রবণতা দেখে স্বাস্থ্য অধিকর্তার অভিমত, ‘‘কিছু দিন আগেও দৈনিক ২০ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় সংক্রমিত হচ্ছিলেন। সেটা এখন সাড়ে ৪ হাজারে নেমে এসেছে। সার্বিক ভাবে অবশ্যই রাজ্যের করোনা সংক্রমণ কমেছে। এর মধ্যে করোনার নতুন কোনও রূপ না এলে আগামী কয়েক দিনে করোনা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।’’
তবে একই সঙ্গে দার্জিলিং, কালিম্পং-সহ উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় সংক্রমণ কিছুটা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। তাই নজরদারিতে ঢিলেমি দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা।
বিদেশের করোনা পরিসংখ্যান দেখে চিকিৎসক কুণাল সরকার মনে করছেন, করোনার বর্তমান স্ফীতি ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ থাকছে। সংক্রমণের প্রথম দু’সপ্তাহে ঝড়ের গতিতে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বড় সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হওয়ার পর একটা পর্যায়ে পৌঁছে সংক্রমণের সংখ্যা থিতু হচ্ছে। তার পর একই রকম গতিতে কমেও যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হবে না বলেই মনে করছেন তিনি। কুণালের মতে, ‘‘শুধু মোট আক্রান্তের সংখ্যার নিরিখে নয়। রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংক্রমণের হার, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করতে হবে।’’ তাই কলকাতায় আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও শহর ছাড়িয়ে করোনার আঞ্চলিক গতিপ্রকৃতির উপর ‘কড়া নজর’ রাখা দরকার বলে মনে করছেন কুণাল।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের উপাধ্যক্ষ আশিস মান্না এবং চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারও মনে করছেন, কলকাতা এবং সন্নিহিত অঞ্চলে করোনা স্ফীতি ইতিমধ্যেই শিখর ছুঁয়ে ফেলেছে। এবার সংখ্যা নীচে নামার পাল শুরু হয়েছে। তবে গ্রামাঞ্চলগুলি যাতে নতুন স্ফীতির ‘এপিসেন্টার’ হয়ে না ওঠে, সেদিকে খেয়াল রাখে হবে বলেই তাঁদের অভিমত।
আশিসের বক্তব্য, ‘‘গত কয়েকদিনে কলকাতা এবং শহরতলিতে সংক্রমণ শিখর ছুঁয়ে নামতে শুরু করেছে। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।’’ তবে পাশাপাশিই তিনি বলছেন, ‘‘গত দু’বছরে করোনা বহুবার আমাদের অবাক করেছে। আরএনএ ভাইরাসদের চলে যেতে যেতেও পিছু ফেরার অভ্যাস আছে। শহর এলাকা বা পর্যটন কেন্দ্রগুলিত, যেখানে করোনা প্রথমে বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল, সেখানে এখন সংক্রমণ কমছে। তবে জেলায় সংক্রমণ কিন্তু বাড়ছে।’’
করোনা বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র (যিনি নিজেও সাম্প্রতিক স্ফীতিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন) মনে করেন, কলকাতার করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং চলতি স্ফীতির বিরুদ্ধে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হয়েছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের অবস্থা নিয়ে তিনিও অতটা নিশ্চিত নন। তাঁর মতে, ‘‘অতিমারির সব সময় একটা লেজ থাকে। অর্থাৎ, কয়েক দিনের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটা কমে গেলেও হাজারের আশেপাশে আক্রান্তের সংখ্যা আটকে যেতে পারে এবং সেটা সেটা কয়েক মাস চলতে পারে।’’ কলকাতা এবং শহরতলিতে কিছুদিনের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা আরও কমবে এবং সেই স্থিতাবস্থা আগামী কয়েকমাস থাকবে বলেই মনে করছেন দীপ্তেন্দ্র।
রাজ্যে সংক্রমণের হার কমার সঙ্গে সঙ্গে গত কয়েকদিনে ‘র্যাপিড অ্যান্টিজেন’ পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, ‘র্যাপিড অ্যান্টিজেন’ পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে কি রাজ্যে সংক্রমণের আসল চিত্র সামনে আসছে? রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তার মতে, ‘‘আরটিপিসিআরের থেকে র্যাপিড অ্যান্টিজেন বেশি হলেই যে আক্রান্তের সংখ্যা কমে যাবে, এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। এখন সব হাসপাতালে অন্যান্য রোগীরাও আগের মতোই আসছেন। তাঁদের দ্রুত পরীক্ষা করে দেখতে হচ্ছে। সময় নষ্ট না করে দ্রুত পরীক্ষার জন্য র্যাপিড অ্যান্টিজেন করা হচ্ছে। কম সময়ে পরীক্ষা করার তাগিদে র্যাপিড পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে বাড়িতেও পরীক্ষা করছেন। এ ক্ষেত্রে শুধু সংক্রমণের সংখ্যা নয়, সংক্রমণের হারের উপরেও সমান নজর রয়েছে আমাদের।’’
আশিসের মতে, ‘‘পর্যাপ্ত পরীক্ষা এবং সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নীচে থাকলে পরিস্থিতি ভালর দিকে বলা যায়। সঠিক পরিসংখ্যানের জন্য বাড়িতে যাঁরা নিজেরাই করোনা পরীক্ষা করছেন, তাঁদের রিপোর্টও আইসিএমআরের পোর্টালে আপলোড করতে হবে।’’
করোনার চলতি স্ফীতিতে সংক্রমণ এবং তীব্রতা দু’টিই আগের থেকে কমেছে বলে জানাচ্ছেন ‘ভাইরোলজিস্ট’ সুমন পোদ্দার। তাঁর মতে, ‘‘ফেব্রুয়ারির প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে করোনার চলতি স্ফীতি শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘আগের অতিমারি থেকে দেখা গিয়েছে, ভাইরাস যখন কম সময়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তখন কমেও যায় অল্প সময়ের মধ্যে। একই রকম ভাবে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা যখন অল্প অল্প করে রোজ বাড়তে থাকে, সেই স্ফীতির মেয়াদ হয় বেশি। যেমনটা আমরা করোনার প্রথম দু’টি ঢেউয়ের সময় লক্ষ্য করেছিলাম।’’ কুণালের মতেও করোনার তীব্রতা কমেছে। আগের গুরুতর নিউমোনিয়া থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে। এমন চললে গরম পড়ার আগেই এই ঝামেলা থেকে রেহাই মিলবে।
২৫ জানুয়ারির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজ্যের সংক্রমণের হারের তুলনায় দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুরের মতো কিছু জেলায় সংক্রমণের হার কম হলেও বীরভূম, বাঁকুড়া, দার্জিলিংঙ-সহ বেশ কিছু জেলায় সংক্রমণের হার বেশি। তাই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী না হয়ে নজরদারি চালিয়ে যেতে হবে বলে জানিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা।