“যদি বর্ষে মাঘের শেষ / ধন্যি রাজা পুণ্যি দেশ” কী বলছে খনার বচন
সৌভিক রাজ
আবহাওয়া জানান দিচ্ছে এবারের মতো উত্তরে হাওয়া দেশ, দরজায় কড়া নাড়ছে ঋতুরাজ। শীত নাইটওয়াচ ম্যানের মতো ব্যাটিং চালাচ্ছে। আবহাওয়া দপ্তর বলছে ফের ভিজতে চলেছে বঙ্গ। দূষণ জলবায়ুর পরিবর্তন ডেকে এনেছে, ফলে সব ঋতু জুড়ে সারা বছরই বর্ষা চলে বাংলায়। এ বছরের মতো মাঘ মাস শেষ হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। সেই সঙ্গে বিদায়বেলায় মাঘে বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কী বলছে প্রচলিত ইতিহাস। প্রতি মাসের মতোই মাঘের বৃষ্টি নিয়ে বলে গিয়েছেন খনা বা ক্ষণা, ওরফে লীলাবতী! খনা জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক মহিলা। তিনিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি। তিনি একাধারে কৃষিবিদ, পরিবেশবিদ আবার গণিতেও তাঁর অসামান্য পারদর্শীতা ছিল।
তাঁকে নিয়ে কিংবদন্তির শেষ নেই। একটি মতানুযায়ী, খনা ছিলেন বারাসতের লাগোয়া দেউলিয়া গ্রামের বাসিন্দা। আবার কেউ কেউ বলেন, খনা সিংহলের রাজকন্যা। যদিও খনার জন্ম ও বংশপরিচয় নিয়ে নানান মত প্রচলিত রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রাচীন লিখিত রূপগুলো সবগুলোই ছিল কাব্যাকারে, ছন্দের ব্যবহার নজর কাড়ত। এমনকি প্রাচীনতম লোকশাস্ত্রের ধারাটিও ছিল কাব্য, যেহেতু অন্তমিল যুক্ত তাই ছড়া বলাই শ্রেয়। বাংলার লোকশাস্ত্রের পুরোধা খনার বচন, যার প্রনেতা হলেন স্বয়ং খনা। এছাড়াও ডাকের বচনও রয়েছে। ইতিহাস বলে, খনার সুলিখিত ছড়া এক বিশেষ ঘরানার লোকশাস্ত্রের জন্ম দেয়। এটাই বচন। পদাবলি সাহিত্যেও ছন্দের ব্যবহার ছিল। হীরক রাজার দেশে সিনেমাতেও আমরা হীরক রাজের বচন শুনেছি। খনাই এই সব বচন ঘরানার স্রষ্টা। তবে খনা শাস্ত্রীয় বা ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত স্বতন্ত্র ছন্দবদ্ধ পদ রচনা করেছেন। যার মধ্যে লুকিয়ে রাখা রয়েছে উপদেশ, ভবিষ্যদ্বানী। কৃষি, বাণিজ্য, পশুপালন, ভ্রমণ, স্বাস্থ্য, আবহাওয়া, পরিবেশ, গৃহ নির্মাণ মানুষের যাবতীয় প্রয়োজনের কথা স্মরণে রেখেই বচন রেখে গিয়েছেন খনা। তবে তাঁর কৃষি সংক্রান্ত বচনের সংখ্যাই বেশি। এদেশের অর্থনীতি যে কৃষি নির্ভর তারও প্রমান দেয় খনার বচন।
‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুণ্য দেশ’ খনার বচন হিসেবে এই বাক্যটি বহুলপ্রচলিত। আদপে বংশপরম্পরায় এই বচনগুলো বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এর মর্মার্থও অতি সহজ, এর সঙ্গে প্রকৃতি, কৃষি কাজ মিশে রয়েছে। মাঘের শেষের বৃষ্টিপাত রাজা ও তাঁর সাম্রাজ্য অর্থাৎ দেশের জন্য কল্যাণকর। মাঘ মাসের শেষের দিকে বৃষ্টি হলে কৃষি কাজ ভাল হয়। এ সময় বৃষ্টি হলে তা আমের নতুন মুকুলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও শীতে গাছের পাতা ঝরে যায়, তারপর মাঘের বৃষ্টি গাছের সবুজ পাতা বিস্তারের মাধ্যমে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। মূলত মাঘ মাস হল রবিশস্যের মরশুম। এই সময় চাষাবাদ ভাল হলে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে, ফলে উপার্জন হয়। খাদ্যাভাবও দেখা দেয় না। এই সময়ের ফসল ভাল হলে, আগে হয়ত পুন্যাহের সময় খাজনা দিতেও কৃষকদের সমস্যা হত না। তাই বৃষ্টি দেশের ফসল ফলার জন্য অত্যন্ত উপকারী। অর্থাৎ এই সময়ের বৃষ্টি আর্থিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। বচন নিছক পদ নয়, বাস্তব পরিস্থিতির এক প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে খনার বচনে, এবার আবহাওয়াবিদদের পূর্বাভাস সত্যি হলে বচন বাস্তবেও মিলতে চলেছে।