অগ্নিশ্বর: ‘কাঁটাবুনে মুখুজ্জ্যে’ ভাইদের এক অসামান্য যুগলবন্দী
সৌভিক রাজ
হুগলির শিয়াখালা গ্রামে ছিল মুখার্জীদের পূর্বপুরুষদের আদি বাড়ি। বাড়ির কাছেই কাঁটাঝোপ-ঝাড়ের বন থাকায়, তাঁদের নাম হয়ে যায় কাঁটাবুনে মুখুজ্জ্যে। এই পরিবারের অন্যতম কৃতিসন্তান বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। তিনি পাতায় রাজত্ব করেছেন বনফুল নামে,এই ছদ্মনাম নেওয়ার মধ্যমেই বলাইচাঁদের লেখক জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
বনফুলের জন্ম বিহারে, ১৯শে জুলাই, ১৮৯৯। তাঁর বাবা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন চিকিৎসক যার কর্মস্থল ছিল বিহার। বিহারেই বনফুলের বেড়ে ওঠা, সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে হাইস্কুলে পড়ার সময় ১৯১৫ সালে ‘মালঞ্চ’ পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশের মধ্যে দিয়েই তাঁর লেখালেখির জীবন শুরু হয়। যদিও এর আগে থেকেই ‘বিকাশ’ নামের একটি হাতে লেখা প্রকাশিত তাঁর লেখালিখি চলত। বলাইয়ের বনফুল হওয়ার পথ বাতলে দিয়েছিলেন এক অগ্রজ সুধাংশুশেখর মজুমদার। সেই থেকে বনফুল ছদ্মনামটি নেওয়া।
বনফুলের কলম অনেক উপন্যাসের জন্ম দিয়েছে। সেগুলি রুপোলি পর্দাতেও উঠে এসেছে, তাঁর উপন্যাস নিয়ে মৃণাল সেন ভুবন সোম বানিয়েছেন। তাঁর কাহিনী নিয়ে আরেকটি অসামান্য ছবি হল হাটে-বাজারে।
তাঁর গল্প অবলম্বনে তৈরি হওয়া সিনেমার মধ্যে অন্যতম হল অগ্নিশ্বর। পরিচালক তাঁর আপন ছোট ভাই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। মুখার্জী বাড়ির এই ছেলে পর্দা কাঁপিয়ে ছিল। যদিও ক্যামেরার পিছন থেকে, তবে পর্দায় রাজত্ব কিন্তু শুরু হয়েছিল ক্যামেরার সামনে থেকেই… বিখ্যাত পরিচালক কালীপ্রসাদ ঘোষের সিনেমা ধাত্রীদেবতায় রামরতন মাস্টারের চরিত্রে অভিয়ন করে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের রুপোলি পর্দার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
তারপরই বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজেকে টাটা করেছিলেন ইন্ডাস্ট্রির ঢুলু বাবু। ডাক্তারি ছেড়ে স্বনামধন্য একজন পরিচালক হলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে পড়াকালীন, তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়। পুরো ফিল্মী ব্যাপার সব। পর্দায় ও পাতায় রাজত্ব করেছেন ‘কাঁটাবুনে মুখুজ্জ্যে’ ভাইরা, এক উপন্যাস মিলিয়েছে দুই’ভাইকে। বাংলা ছবি নায়কের ভয়ঙ্কর ব্যক্তিত্ব দেখা যায় না। গত বিশ বছরের কথা বলতে গেলে, লাঠির ভিক্টর ব্যানার্জির রোলটার কথা বলতে হয়। কিন্তু তাও অগ্নিশ্বর ফার অ্যাহেড! কোন ভারতীয় সিনেমাতে হয়ত এমন ব্যক্তিত্বের অভিনয় ফুটে ওঠেনি। নায়ক যে আমাদের উত্তম বাবু। ছবি একটি শো লেখক নিজেও দেখতে গিয়েছিলেন।
নিউ থিয়েটার্সে অগ্নিশ্বর’ সিনেমার একটি শো চলছে। পরিচালক, উত্তমকুমার, সকলেই রয়েছেন। মহানায়ক একটু ভয়ে ভয়ে আছেন, কে জানে কী বলবেন লেখক। ‘শো’ শেষ। কিন্তু বনফুল কিছুই বলছেন না। উত্তমকুমারের আর তর সইছে না। তা দেখে পরিচালক নিজেই তাঁর দাদাকে বললেন, ‘উত্তম কেমন করেছে, বলবে তো!’
এবার আর অপেক্ষা করাননি বনফুল। হাসতে হাসতে মহানায়কের কাঁধে হাত রেখে বনফুল বললেন, ‘অপূর্ব! অগ্নিশ্বরের ব্যক্তিত্বকে তুমি সুন্দর ফুটিয়েছ।’
উত্তম কুমারের অভিনয় জীবনকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন অরবিন্দ বাবু। একদিকে অগ্নিশ্বর অন্যদিকে ধন্যি মেয়ে, মৌচাক! ভাবা যায় উত্তর আর দক্ষিণ! একদিকে সিরিয়াস আর অন্যদিকে দম ফাটা হাসির রোল। উত্তম কুমারের পথে হল দেরীতে পরিচালক বিভূতি লাহাকে অ্যাসিস্ট করেছিলেন অরবিন্দ বাবু। প্রথম ছবি কিছুক্ষণ দিয়েই কেল্লাফতে করেছিলেন। উত্তম-সাবিত্রীকে নিয়ে নিশিপদ্ম বানিয়েছিলেন। পরে রাজেশ খান্না আর শর্মিলা ঠাকুরকে শক্তি সামন্ত বানালেন অমর প্রেম, তার চিত্রনাট্যটিও ঢুলুদার করে দেওয়া।