মহাবীর চিলারায় – যাঁকে নিয়ে কিংবদন্তির শেষ নেই
আজ মহাবীর চিলারায়ের ৫১২তম জন্মবার্ষিকী। তাঁকে নিয়ে কিংবদন্তির শেষ নেই! কারও মতে, তিনি বীর সূর্য। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি মহাবীর। যদিও তাঁর প্রকৃত নাম শুক্লধ্বজ। ১৫১০ সালের মাঘী পূর্ণিমায় চিলারায়ের জন্ম। অসমীয়া ভাষায় ঘুড়িকে “চিলা” বলা হয়। স্থানীয় রাজবংশী ভাষা অনুযায়ী, চিলা হল শিকারি পাখি চিল। চিলা ঘুড়ি, আবার কখনও চিল পাখির গতিবেগের সঙ্গে মিলিয়ে কামতাপুর রাজকুমার হয়ে গেলেন চিলারায়। আবার অন্য একটি মতে, তিনি কামতাপুর রাজ্যের দেওয়ান তথা মন্ত্রী ছিলেন বলে তাঁর আরেক নাম হয় “চিলারায় দেওয়ান।”
লোকবিশ্বাস মতে, কামতাপুরের অর্থাৎ কোচবিহার কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহের তৃতীয় পুত্রই হলেন চিলা রায়। চিলারায়ের মা পদ্মাবতী ছিলেন গৌড়ের মেয়ে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, চিলের মতো দূরন্ত গতিতে ছোঁ মেরে গেরিলা কায়দায় শত্রুকে তুলে নিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখতেন বলেই মহাবীরের নাম হয়েছিল চিলা রায়। লোকমুখেই তাঁর নাম ও গুণ প্রচলিত হয়েছিল। নাম শুনলেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শত্রুসৈন্য পালাত। গেরিলা যুদ্ধরীতির আবিষ্কারক হিসেবে ইতিহাসে চিলারায়ের নাম বিখ্যাত হয়ে আছে। রাজা বিশ্বসিংহ মৃত্যুর আগে বলে যান, তাঁর জ্যোষ্ঠপুত্র নরসিংহ বিদেশে যাবেন, আরেক পুত্র নরনারায়ণ রাজ্য শাসন করবেন এবং অন্য পুত্র চিলারায় রাজ্যের সেনাপতি হিসেবে রণধর্ম পালন করবেন।
কিন্তু রাজা বিশ্বসিংহের মৃত্যুর সময় নরনারায়ণ ও চিলারায় বিদ্যাশিক্ষার জন্য বারাণসীধামে ব্রহ্মানন্দ বিশারদ নামে এক সন্ন্যাসীর কাছে ছিলেন। এই বারাণসীধামেই শিক্ষা গ্রহণ করে নরনারায়ণ ও চিলারায় দুই ভাই সকল হিন্দুশাস্ত্রসহ যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। নরনারায়ণ ছিলেন চিলারায়ের বৈমাত্রেয় দাদা। বিশ্বসিংহের আরেক স্ত্রী হেমপ্রভা ছিলেন নরনারায়ণ জননী। অন্য দুই ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে রাজা বিশ্বসিংহের মৃত্যুর পরে বিশ্বসিংহের জ্যোষ্ঠপুত্র নরসিংহ সিংহাসনে বসে গিয়েছিলেন। এদিকে রাজাদেশ লঙ্ঘিত হতে দেখে, সব ঘটনা সবিস্তারের জানিয়ে নাগভোগ নামে রাজার অনুগত এক সন্ন্যাসীর মারফত অন্দরমহলের রতনী ধাই এক পত্র পাঠালেন বারাণসীতে। পত্রে দুই ভাইকে দ্রুত রাজধানীতে আসতে বলা হয়।
পত্র পেয়েই নরনারায়ণ ও চিলারায় দ্রুত রাজধানী ফিরে আসেন এবং দাদা নরসিংহকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। এরপর পিতৃ ইচ্ছাপূরণ হয় ১৫৩৪ সালে কামতাপুর রাজ্যের রাজা হলেন নরনারায়ণ, চিলারায় হলেন রাজ্যের সেনাপতি। নরনারায়ণ তাঁর রাজ্যাভিষেকের সময় ভাই চিলা রায়কে সংগ্রাম সিংহ উপাধিতে ভূষিত করলেন।
এরপর রাজা নরনারায়ণ ভাই চিলারায়কে নিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্যোগ নেন। ১৫৬৩ সালের জুন মাসে আসমের রাজধানী গুড়গাঁও দখল করে নেন চিলারায়। এরপরই কাছাড় আক্রমণ করে দখল করলেন রাজধানী মাইবং। কাছাড়ের পর একে একে মণিপুর, শ্রীহট্ট, খাইরাম, চট্টগ্রাম ও ডিমুরিয়া জয় করেন। চিলারায়ের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারালেন জয়ন্তীয়ারাজ, ত্রিপুরারাজ ও সিলেটরাজ। বর্তমান উত্তরবঙ্গ, বাংলাদেশের একতৃতীয়াংশসহ গোটা অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করছিলেন চিলারায়।
পরাক্রমী বীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অত্যন্ত মানবিক ছিলেন চিলারায়। সাধারণ মানুষ ও আত্মসমর্পণকারী কোন শত্রুর সঙ্গেই কোনরকম দুর্ব্যবহার করতেন না। পরাজিত রাজার কাছ থেকে শুধুমাত্র শ্রদ্ধা ও সম্মান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন। এমনকি, রাজবন্দীদের পর্যন্ত তিনি জমি দিয়ে তাদের পুনর্বাসন দিতেন।
অনেক ঐতিহাসিকই ইতিহাসখ্যাত ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনার্পাটের সঙ্গে চিলারায়ের বীরত্বের তুলনা করেছেন। নেপোলিয়নের মতোই তিনিও এক শক্তিশালী নৌবাহিনী তৈরি করেছিলেন। দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে নদী ডিঙিয়ে শত্রুপক্ষের সৈন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কামতাপুররাজ নরনারায়ণ ও চিলারায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় অসমের যুগপুরুষ শঙ্করদেব সমগ্র অসম জুড়ে তাঁর প্রচারিত “এক শরণ নাম ধর্ম” প্রতিষ্ঠিতা করেন। শঙ্করদেবের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে রাজা নরনারায়ণ তাঁকে রাজপণ্ডিতের মর্যাদা দিয়েছিলেন।
রাজা নরনারায়ণ ও চিলারায়েরা প্রথমে ছিলেন শৈব। নিজেদের সাম্রাজ্যে তাঁরা বহু শিবমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এরপর শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের সাহচর্যে এসে তাঁরা বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন এবং মদনমোহন ঠাকুরবাড়ি তৈরি করেন। এছাড়াও মুসলমান আক্রমণে বিধ্বস্ত অসমের কামাখ্যা মন্দিরটিকেও পুনরায় নির্মাণ করেছিলেন। শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের ভাগ্নি কমলপ্রিয়া ওরফে ভুবনেশ্বরীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন চিলারায়। ১৫৭১ সালে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মহান বীর চিলারায়ের জীবনাবসান হয়।
কোচবিহারের তুফানগঞ্জে প্রায় ৫৬ বিঘা এলাকা জুড়ে রয়েছে “চিলারায়ের গড়।” তাদের বাড়ি ভূমিকম্পে মাটির তলায় চলে গিয়েছে। ওই এলাকায় একবার মাটির তলা থেকে সোনার থালা-বাটি, রূপোর সিন্দুক বেরিয়ে এসেছিল বলেও জানা যায়। পদ্মফুলের নকশা তোলা চৌকো ইট আজও এই এলাকায় পাওয়া যায়। মাটির তলা থেকে চিলারায়ের শিবমন্দির বেরিয়ে এসেছে, সেখানে প্রতি বছর অষ্টপ্রহর কীর্তন আয়োজিত হয়। অসমের ধুবড়িতে চিলারায়ের মূর্তি বসানো হয়েছে।