চড়াইয়ের রূপকে বৃহত্তর বার্তা দিল ‘ব্যাধ’
অগ্নিভ নিয়োগী
অবশেষে হইচই তে দেখলাম ব্যাধ। রাজর্ষি দাস ভৌমিক সৃষ্ট গোয়েন্দা কানাইচরণের ‘চড়াই হত্যা রহস্য’ গল্প অবলম্বনে অভিরূপ ঘোষের মিনি সিরিজ। নাম ভূমিকায় রজতাভ দত্ত। সহকারীর ভূমিকায় সৌমান বোস। হত্যাকারীর চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী। কলকাতা নুয়া বইটা যখন পড়েছিলাম, তখনই মনে হয়েছিল কানাইচরণের কেসগুলো একটা ফ্রাঞ্চাইজি হতে পারে। ক্ষুরধার, তীক্ষ্ণ লেখনি আর রহস্যে টইটম্বুর গল্পগুলো অত্যন্ত মনোগ্রাহী। পড়তে পড়তেই চোখের সামনে কল্পনা করতাম দৃশ্যগুলো। ব্যাধ দেখতে দেখতে সেই অনুভূতিই ফিরে এসেছে। ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম। অভিনেতা নির্বাচনের ভিত্তিতেই ফুল মার্কস প্রাপ্য পরিচালকের। ৬ এপিসোডের সিরিজ। একটা সাব-প্লট ছাড়া একবারও মনে হয়নি ফরওয়ার্ড করে দেখি।
লালবাজারে নতুন ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়েছে – নাম ডিপার্টমেন্ট অফ আনইউসুয়াল কেসেস (অস্বাভাবিক কিছু মামলার নিষ্পত্তি করতে নতুন বিভাগ)। গালভরা এই নামটা শুনলেই হ্যারি পটারের ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজ এর কথা মনে পড়ে যাবে। শুনতে কেউকেটা হলেও, আদপে এই ডিপার্টমেন্ট হল পানিশমেন্ট পোস্টিং। দুর্নীতিতে বাধা দেওয়া কিংবা মন্ত্রীর আত্মীয়দের অসম্মান করার মূল্য চোকাতে এই ডিপার্টমেন্টে ‘পেইড লিভ’ কাটাতে পাঠানো হয় অফিসারদের। নবাগত সৌভিকের আগমনও সেই কারণেই। কানাইচরণের কাছে ট্রেনিং নেওয়ার কথা তার। ঘটনাচক্রে দুজনে জড়িয়ে পড়ল এক অদ্ভুত সিরিয়াল কিলিংয়ের চক্রব্যূহে।
যে কারণে এই সিরিজটা এত ভালো লেগেছে আমার, তা হল হু ডান ইট ফরম্যাটে না বানিয়ে অভিরূপ গল্পটা হোয়াই ডান ইট ফর্মুলায় ফেলেছেন। সিরিয়াল কিলার কে, আমার প্রথম দৃশ্যেই জেনে যাই। কিন্তু কেন সে নিরীহ প্রাণীগুলোকে মারছে, সেটা বলতেই ৬ এপিসোডের এই গল্প। সিরিজের দৃশ্যায়ন ধূসর রঙে কর হয়েছে। একদিকে লালবাজারের বদ্ধ চিলেকোঠার ঘর, অন্যকে শস্য শ্যামলা হরিৎক্ষেত্র – ফারাকটা ভালো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জমাট বাঁধা মেঘ, হঠাৎ বৃষ্টি, গুমোট পরিবেশ। যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। চিত্রগ্রহণে সুনৈপুণ্য গল্পের মানকে অনেকটা উঠিয়ে দেয়। সঙ্গত দিয়েছে আবহ সঙ্গীত। দর্শকের ভেতরে রহস্য যাতে আরও দানা বাঁধে, তা নিশ্চিত করেছে দুর্দান্ত আবহ।
অভিনেতাদের কথা তো আগেই বললাম। প্রতিটি চরিত্রে অভিনেতা বাছাই অনবদ্য। রজতাভ দত্তের কথা নতুন করে আর কী বলব? কানাইচরণের চরিত্র যেন ওনাকে মাথায় রেখেই লেখা হয়েছিল। সৌমান বোসও সহকারীর চরিত্রে যথাযথ। দুটি ছোট চরিত্রে দাগ কেটে যাবে খরাজ মুখোপাধ্যায় ও অনুসূয়া মজুমদারের অভিনয়। আর ভিলেনের চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী এক কথায় সিন্-স্টিলার। একেনবাবু আর জটায়ুর ছায়া কাটিয়ে নিজের অভিনয়-ক্ষমতা উজাড় করে দিয়েছেন দর্শকদের জন্য।
কিন্তু, যে কারণে ব্যাধ সিরিজটি দেখা অত্যন্ত প্রয়োজন তা হল এর অন্তর্নিহিত বার্তা। একটা চিন্তাধারা বদলে দিতে পারে সমাজ। প্রভাবিত করতে পারে গোটা প্রজন্মকে। ধারণার তাই বিকল্প হয়না। কিন্তু শাসকের অঙ্গুলিহেলনে যখন সমর্থকরা উন্মত্ততায় মেতে ওঠে, ঠিক-ভুলের পার্থক্যটা ভুলে যায়, তখন সমূহ বিপদ। তখন দরকার হয় এমন কাউকে যে বলতে পারে রাজা, তোর কাপড় কোথায়? চড়াই তো রূপক মাত্র। বৃহত্তর স্বার্থে দুর্বলের নিধনযজ্ঞ অনন্তকাল ধরে দেখে আসছে এই ধরাভূম। ভবিষ্যৎকে বদলাতে চাই নতুন ‘চিন্তাধারা’।