ক্ষুধার্ত সৃষ্টি ও স্রষ্টাদের কথা
শিল্প ও শিল্পীর কাজ মানুষের কথা বলা। সময়কে তুলে ধরা। যে জিনিস সময়ের প্রতিফলন করতে পারে, তা মহাকালকে জয় করে। সাহিত্য এক অপার সৌন্দর্যের শিল্প মাধ্যমে, কখনও সাহিত্য মানুষের কথা বলে, কখনও সে জনমত গড়ে, আবার কখনও সে প্রতিবাদ করে, সে হয়ে ওঠে লড়াই সংগ্রামের ভাষা। গল্প-কল্প কথা নয়, রূঢ় বাস্তবের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরাই সাহিত্য-শিল্পের কাজ। পাতায় পাতায় প্রতিবাদ লিখে সাহিত্য স্রষ্টারা তা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। এমনই এক আন্দোলন হয়েছিল বাংলা কবিতাকে ঘিরে।
সে আন্দোলন ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধী। কথায় কথায় প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ! আর হার না মানা মানসিকতা। শাব্দ-ছন্দ তার হাতিয়ার। এক দল তরুণের লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে এই লড়াই। হাংরি আন্দোলনকারীরা তাদের এই আন্দোলনকে ‘কালচারাল কাউন্টার’ বলতেন। পশ্চিমে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী একটি প্রজন্ম, কালচারাল কাউন্টার ঘটিয়ে নতুনধারার এক সমাজের বীজ বুনে ফেলেছে। আমেরিকার ‘বিট জেনারেশন’ আর ব্রিটেনের ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যান’ গোষ্ঠির লেখকেরা মূলধারার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আঘাত হেনে বিশ্বে জনপ্রিয়। অনেকে এজন্যই হাংরি জেনারেশনকে বিট জেনারেশনের সাথে তুলনা করলেন। বিট জেনারেশনের অনুপ্রেরণাতে হোক বা যেভাবেই হোক না কেন, ১৯৬১ সালে পাটনা থেকে রীতিমতো ইস্তাহার ছাপিয়ে আন্দোলন শুরু করলেন মলয় রায়চৌধুরীরা। বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন প্রচলিত ধারার সাহিত্য আর সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কবিতার ইস্তাহারে তিনি লিখলেন, “শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত”। আরও লিখলেন, “এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে”। রাজনীতির বিরুদ্ধেও আঘাত আনলেন,“রাজনৈতিক বিশ্বাসের চেহারা পালটে দেওয়া হবে”।
মলয় রায়চৌধুরীর বড় দাদা সমীর রায়চৌধুরী হাংরি বুলেটিন ছাপানোর অধিকাংশ খরচ দিতেন। ১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণাবিধান মুখোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, সতীন্দ্র ভৌমিক, অজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, তপন দাশ, মনোহর দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের যোগ দেন।
ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের বাক্য “The Sour Hungry Time” আর জার্মান দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের ‘The Decline of the West’ গ্রন্থ থেকে হাংরি আন্দোলনের ধারণার জন্ম হয়েছিল। আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তিটিই ছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্টের দর্শন। স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না।
তবে শৈলেশ্বর ঘোষের মতে, ‘হাংরি জেনারেশন’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ১৯৬২ সালে বিনয় মজুমদারের কবিতার সমালোচনা প্রসঙ্গে শক্তি বলেছিলেন, বিদেশের সাহিত্যকেন্দ্রে যে ধরনের আন্দোলন চলছে, তেমন আন্দোলন এখানে হলে তা কেবলমাত্র ক্ষুধা সংক্রান্ত হতে পারে। তাঁর কথায়, “ওদিকে ওদেশে সামাজিক অবস্থা অ্যাফ্লুয়েন্ট, ওরা বিট বা অ্যাংরি হতে পারে। আমরা কিন্তু ক্ষুধার্ত।” এই ক্ষুধা অবশ্য আক্ষরিক অর্থে ক্ষুধা নয়। সাহিত্যের মাধ্যমে মনেরভাব প্রকাশের ক্ষুধা, যথার্থ শব্দ প্রয়োগের ক্ষুধা, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা আর অবদমিত বাসনা পূরণের ক্ষুধা।
কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের আক্রমণে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়। এমনকি কবিদের বিরুদ্ধে মামলা, মোকদ্দমা চলে। আন্দোলন হয়ত ব্যর্থ হয়েছিল কিন্তু হাংরি আন্দোলন সাবলম্বী করেছিল বাংলা সাহিত্যকে, আধুনিকোত্তর সাহিত্যের ভিত্তিপ্রস্থ মজুবত হয়েছিল এ সময়। এমন নজির পৃথিবীর খুব কম ভাষাতেই রয়েছে। হাংরি আন্দোলন অনন্য করে তুলেছে বাংলার কাব্যধারাকে, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষাই বাংলা কবিতার ক্ষুধা আন্দোলনের স্রষ্টা।