বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

অনন্ত অতল আমিত্বে সুনীল

March 21, 2022 | 2 min read

সৌভিক রাজ

সাহিত্যের নানান প্রকাশমাধ্যম, আর তার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট প্রকাশমাধ্যম হল কবিতা। কতকগুলি উৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোচ্চ উৎকৃষ্ট ব্যাঞ্জনায় পরিবেশন করার নামই হল কবিতা। কখনও সে জনমত গঠনের হাতিয়ার, কখনও সে অনুভূতি প্রকাশের অনন্য মাধ্যম, আবার কবিতা সময়ের দলিলও বটে। আন্দোলন, বিপ্লব, প্রেম, ঈশ্বর, প্রকৃতি সবই ধরা দেয় কবিতায়।

আমাদের মাতৃভাষার সাহিত্য এমন একজনকে পেয়েছে যে, তিনিই সাহিত্যের সময়কলকে ভাগ করে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ও সমসাময়িক সময়কে প্রণিধানযোগ্য ধরে, রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের দুজন কবির কবিতা আমায় বিস্মিত করে, বা আমায় ভাবায় বলাই শ্রেয়। একজনের লেখায় আছে মাধুর্যতা, আরেক জনের লেখা রয়েছে অপার আমিত্ব। সুনীল আর জীবনানন্দ। না, কোন তুলনা টানা নয়, যাদের কবিতা তৃপ্তি দেয় এমন দুজনের নাম লিখতেই এঁদের নাম পাশাপাশি লেখা। তবে আমি আমার সুনীলকাব্যানুভূতি ভাগ করে নেব আজ।

কবিতার নানান ব্যাকরণ রয়েছে, গঠনশৈলীর পার্থক্য রয়েছে, কবিতা নিজের মতো গড়ে ওঠে। তার নিজস্ব সুর-তাল-লয় রয়েছে।
সুনীল বলতেই মনে পড়ে দিগন্তবিস্তৃত সুনীল আকাশ, অতল সমুদ্দুরের কথা। সুনীলের কবিতাও আমার কাছে তাই, ঔপন্যাসিক সুনীল হেরে গিয়ে আমার কাছে কবি সুনীল জয়ী। হয়ত কবির নিজের কাছেও, কবি সুনীলই বিজয়ী। কবিতায় গদ্য ব্যবহার সুনীলের আনা নয়, বহু কাল ধরেই গদ্য এসেছে কবিতায়। তাও সুনীলের কাব্যের গদ্যাঙ্গিক মুগ্ধ করে। এক অনন্য অনুভূতি যোগায়। কারণ ওঁর কবিতার ভাষায় আমিত্ব মিশেছে।

সুনীল আমিত্ব-এর কবি। আমার মতে, এই আমিত্বই তাঁর কাব্যকে অনন্য করে তুলেছে। আলাদা করেছে আর পাঁচটা আধুনিকোত্তর কবিতা থেকে, তাঁর কবিতায় চাওয়া আছে, না পাওয়া আছে, রূঢ় বাস্তবের আঁচড় আছে, কিন্তু সেই সঙ্গে আমিত্বের এক উন্মত্ততা আছে।
“বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন দেখিস আমরাও, বাবা এখন অন্ধ। আমাদের দেখা হয়নি কিছুই।” কবিতায় এর চেয়ে বাস্তব আর কী কিছু হতে পারে? এর’চেয়ে সহজে একজন কবি কবিতার শব্দছন্দে বাস্তবতাকে ছুঁতে পারেন বলে মনে হয়না!

আমি-র চোখে জগৎ দেখা। প্রেমিকার শরীর খারাপ বলে শহর জুড়ে মন খারাপ নামিয়ে আনা, বারুনার জন্য নীল পদ্ম আনা, এ’সবের মধ্যে এক তরুণ তো নিজেকেই খুঁজে পাবে। তখনই তৈরি হবে সংযোগ, কবির সঙ্গে কবিতার পাঠকের সংযোগ তৈরি হলেই আমিত্ব পূর্ণিতা পায়। মনে হয় আমিই তো কবি, আমিই গিরিশ আমিই নরেন, একে অন্যকে টানছি, বিষ পান করে মরে যাচ্ছি, নবীর কিশোরকে ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশকে উপহার দিচ্ছি।

বাংলা কবিতায় হাংরি আন্দোলন হয়েছে, কবিতার বহু ধারার বিবর্তন হয়েছে, কবিতা নিজেকে পাল্টেছেন, সুকান্ত- শঙ্খবাবুরা প্রতিবাদের ভাষা বানিয়েছেন কবিতাকে, আজকের একুশ শতকে কবিতা এক অন্য রকম আঙ্গিকে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আজও অসীম অক্ষত অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুনীলের কাব্য। কারণ যা চিরকালীন তা অবিনশ্বর।
ওঁর আমি-টা কোনদিন পুরোনো হয় না! প্রতিবার বদলে যায় আমির মানে, ক্লাস এলেভেনে পড়া আমি ভাবতাম চৌধুরীদের গেটে ভিখারীর মতো কেন দাঁড়িয়ে ছিলেন সুনীল? আজ বুঝি ঐ দাঁড়ানোটার মানে।

সুবর্ণকঙ্কন পরা ফর্সা রমণীদের দেখতে কেমন লাগে? বারো বছরের আমি-র যেমন লাগবে, চল্লিশ বছরের আমি-র তেমন লাগবে না। এটাই তফাৎটাই তো পরিবর্তনশীল। আর পরিবর্তন হয় বলে, বদল আসে বলে আধুনিকতার জন্ম হয়। চিরন্তন থাকে ওঁর কবিতা।
স্মৃতির সরণি বেয়ে নামে সুনীলের কবিতা, কবি জানতে উদগ্রীব এখনও কী কেউ সূর্যকে প্রণাম করে, নাদের আলী, বোষ্টুমির কথা তাঁর মনে পড়ে, এই স্মৃতির রোমন্থন আরও বেশ চেপে বসে অচেতন মনের আমিসত্তায়। এই অতল অনন্ত আমি-র সন্ধানে আমি ডুব দিই সুনীলে। সাড়ে তিন হাত ভূমি, বিষন্ন আলোর বাংলাদেশে নির্বাসন নেবেন তিনি এখানেও তো সেই আমি-র কথা। স্ব’রূপে অতীত, মুহূর্ত আর আগামীর যাপন। এটাই ওঁর কবিতা। এই মর্মার্থ স্পর্শ করতে পারলেই মনে হয়, ঔপন্যাসিক সুনীলকে হারিয়ে দিয়ে কবি সুনীল জিতে যাচ্ছেন।

বাংলা কবিতা পাচ্ছে বনস্পতির আশ্রয়। কবিতা পাঠে, বৈশাখে পাঠক পাচ্ছে পৌষের আবেশ, বাদল দিনেও মিলছে আকাশ। মেঠোফুলে ভাল থাক ওঁর একলা আমি-র চরণগুলো…

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Sunil Ganguly, #World Poetry Day

আরো দেখুন