বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

শঙ্খধ্বনি, জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক নির্ভীক কবির কথা

March 21, 2022 | 3 min read

সৌভিক রাজ

গত শতকের সাতের দশকে নির্বাচনে জয়লাভ করে বাংলার একটি রাজনৈতিক দল। জয়োৎসবের নামে অত্যাচারের নয়া এক অধ্যায় রচনা করেছিল সে সরকার। এই সময়ের দলিল লিখে গিয়েছেন মাঝ বয়সী শঙ্খ ঘোষ। সময়চেতনার ধর্মকে অগ্রাধিকার দিয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষু ও ক্ষমতাকে নীরব উপেক্ষায় তুচ্ছ প্রমান করে, কলমের দ্বারা শানিত প্রতিবাদে শাসককে আঘাত করে গিয়েছেন শঙ্খ বাবু। সমাজসত্যতাকে কোনদিন ভুলে যাননি তিনি, নিছক বিনোদনকাব্য ভুলে মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কলম ধরাকে অগ্রাধিকার দিয়ছিলেন; তাঁদের অগ্র পথপ্রদর্শক তিনিই।

poet - Shankha Ghosh: Tireless writer, never shy of protest - Telegraph  India

তাঁর প্রতিবাদ গর্জেছে মগ্নস্বরে, কিন্তু কী ভীষণ তীব্র সে প্রতিবাদ। ‘জয়োৎসব ১৯৭২’, ‘তিমির বিষয়ে দু-টুকরো’ থেকে ‘ইন্দ্র ধরেছে কুলিশ’, ‘হাসপাতালে বলির বাজনা’, ‘মার্চিং সং’, ‘রাধাচূড়া’, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’, ‘শৃঙ্খলা’, ‘বাবু বলেন’ – প্রতিটি সৃষ্টিতেই কবির নির্ভীক কলম, ওঁর শিরদাঁড়ার সরলরৈখিক কাঠিন্য, তীক্ষ্ণতাকে পাঠক অনুভব করতে পারে। তাঁর গোটা জীবনটাতেই তিনি নির্ভীকভাবে সময়ের সাহিত্য সৃষ্টি করেগিয়েছেন। জরুরি অবস্থার কোপ পড়েছিল তাঁর কলমে, যেমনটা কিশোরের কণ্ঠে পড়েছিল।

পুজো এসে গিয়েছে, দেশ শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ পাবে। পুরোদমে কাজ চলছে।শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়েছেন সাগরময় ঘোষ, এরই মাঝে হঠাৎ শঙ্খ ঘোষ কানাঘুষা শুনতে পেলেন, তাঁর কবিতা নাকি সেবারের ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হবে না। কারণ সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আকাশ থেকে পড়লেন তিনি।

কিন্তু এ কী করে এমন হয়? এই তো সম্পাদক সাগরময় ঘোষ নিজে তাঁর কবিতা চেয়েনিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করলেন তাঁকে। কথাটা যে গুজব নয়, এক্কেবারে সত্যি- সেটাই জানালেন সাগরময় ঘোষ। রাইটার্স থেকে হুলিয়া জারি করা হয়েছে। রাষ্ট্র বিরোধী লেখা না ছাপানোর নির্দেশ এসেছে। তখন এমন এক পরিস্থিতি কোন বিরোধী কথাই তখন বলা যাবে না! সাগরময় ঘোষ কিন্তু কিন্তু করে, শঙ্খবাবুর কাছে অন্য লেখা চাইলেন। এতে যেকোন লেখক-কবির রাগ হওয়ার কথা, রাগটা স্বাভাবিক। কারণ এ জিনিস অপমানজনক।

কিন্তু তিনি তো শঙ্খ ঘোষ, তিনি শান্তই থাকলেন। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বললেন অনেকটা এরকম, অন্য কোন কবিতা তিনি পাঠাতে পারবেন না। সেই সময় শঙ্খ ঘোষ প্রায় সবই রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখাই লিখছিলেন।

Noted Bengali poet Shankha Ghosh dies of corona | Print Version

সাগরবাবুর প্রতি তাঁর উত্তর ছিল, তার সব লেখাই তো ওইরকম, কাজেই সরকারি হুকুমে সবই বাধাপ্রাপ্ত হবে। তাই তিনি আর লেখা দেবেন না। সেবার সত্যিই তিনি আর দেশে লেখা দেননি।

জরুরি অবস্থার কোপ কিন্তু এরপরেও থেমে যায়নি। সেই সময় স্বল্প খ্যাত পত্রিকা বা লিটিল ম্যাগাজিনগুলো লেখা চাইতে এলেই শঙ্খ ঘোষ প্রথমেই তাঁর শর্ত বলে দিতেন। ছাপতে হলে তাঁর প্রতিবাদী লেখাই ছাপতে হবে। লেখা হুবহু ছাপতে হবে, কোনরকম বদল করা যাবে না। লেখা নিলে ঝুঁকি নিয়ে হলেও ঐ লেখা ছাপাতেই হব। অনেক সম্পাদকই সরকারের ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন। ‘লা পয়েজি’-র সম্পাদক বার্ণিক রায় ও ‘সাহিত্যপত্র’-র সম্পাদক অরুণ সেন কিন্তু পিছিয়ে আসেননি। সেই বছরই, অচলাবস্থার মধ্যেও শঙ্খ ঘোষের ‘রাধাচূড়া’ ও ‘আপাত শান্তিকল্যাণ’ কবিতা দুটি ছাপা হয়।

‘রাধাচূড়া’ এবং ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’ কবিতা দুটির উপর রাষ্ট্রের আঘাত নেমে এসেছিল। শানিত লেখনীতে ছিল শাসককের প্রতি সংযত থাকার নিস্তব্ধ হুঙ্কার! রাষ্ট্রযন্ত্র দমবার পাত্র নয়, ভয়ে শাসক ওই লেখনীর কণ্ঠচ্ছেদ করতে উদ্যত হয়ে উঠেছিল, তৎকালীন সরকার কবিতা দুটিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

poet - Coronavirus outbreak: Sankha Ghosh passes away - Telegraph India

‘রাধাচূড়া’ কবিতাটিকে সরকার নিষিদ্ধ করলে কবির বন্ধু অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মতো নির্ভীক কবি-শিল্পীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়-আয়োজিত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কবি-সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকারে যা ঘটেছিল ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত খুবই কম রয়েছে। ওখানে ‘রাধাচূড়া’কে উপলক্ষ্য করে শিল্পীর স্বাধীনতার সপক্ষে জোরালো সওয়াল করেন অলোকরঞ্জন। প্রকৃত শিল্পীর ধর্ম পালন করতে গেলে তো শিল্পীকে এমনই হতে হয়।
কিন্তু ‘রাধাচূড়া’-কে কেন অমন ভয়ের দৃষ্টিতে দেখেছিল রাষ্ট্রযন্ত্র?

Poet Sankha Ghosh turns ninety on February 5, 2021

‘রাধাচূড়া’ একটি রূপক কবিতা। মালি কর্তৃক গাছের পরিচর্যার রূপকের আড়ালে, স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার নির্লজ্জ প্রচেষ্টাকে নগ্ন করে দিয়েছিলেন কবি।

স্বাধীনচেতা, প্রতিবাদী নাগরিককে যে রাষ্ট্র যন্ত্র ভয় পায়। তাই তাদের পোষ মানানো, বেঁধে রাখা, অবনমিত করার পরিকল্পিত কার্যক্রম চলতেই থাকে। জরুরি অবস্থাও ঠিক তাইই ছিল! যা ছিল উল্টো দিকের আওয়াজ প্রতিবাদ দমিয়ে রাখার ফন্দি মাত্র।

কিন্তু এসব করেও থামেনি, শঙ্খধ্বনি। শঙ্খের কলম নীরবে শাসককে প্রশ্ন করে গিয়েছে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Poem, #sankha ghosh, #world poetry day 2022

আরো দেখুন