এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা, আজ বিশ্ব আবহাওয়া দিবসে জেনে নিন পরিবেশের কথা
সৌভিক রাজ
আচ্ছা, ভাবুন তো পৃথিবীর শেষ হয়ে আসছে! ২০১২ ছবির কোন সিক্যুয়েলের চিত্রনাট্য আপনাদের শোনাচ্ছি না, সেই নোয়ার নৌকো আর মহাপ্লাবনের গল্পও বলছি না। পরিবেশের যে পরিবর্তন হয়েছে, সেটা আমি আপনি সবাই বুঝতে পারছি। জলবায়ু বা আবহাওয়া তার বাঁধাধরা চিরাচরিত গন্ডি পেরিয়ে গিয়েছে, কেবল লক্ষণ রেখা পেরোলেই সর্বনাশ। প্ৰথমেই দেখুন ঋতুর কথা। বাংলায় ঋতু নিয়ে রচনা লিখতে এলে ছয়টি ঋতু বাংলায় দেখা যায় আমার সকলেই লিখব! কিন্তু আদপে ঋতু বলেই এখন বছরের অধিকাংশ সময়ই গ্রীষ্মকাল, বর্ষার কোন নিশ্চয়তা নেই ! প্রায় সারা বছরই একটু আধটু বর্ষা চলতে থাকে। সেই কালিদাসের “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে” ও আর হয় না! ১৫-২০ দিনের শীত, আর বাঙালি বলে দুর্গাপুজোর কল্যানে দিন দশকের কল্পনার শরৎ! কখনও ভেবেছেন কেন এমন হল?
না, বিশ্বউষ্ণায়ন শব্দটির দোহাই দেব না শুধু! দোষ কি কেবল দূষণের আর কল-কারখানার! আসল দোষী যদি কেউ হয় তাহলে, মানুষের স্বাচ্ছন্দপূর্ন-যান্ত্রিক জীবন। আজ থেকে যদি দুই বা আড়াই দশক পিছনে ফিরে যাই, দেখব গাছ আর গাড়ির সংখ্যার কমা-বাড়া ব্যাস্তানুপাতিক হারে, আমার গাছ কাটছি, বেশি বেশি করে গাড়ি কিনছি আর দূষণ বাড়াচ্ছি। ফলে উত্তপ্ত হচ্ছে পরিবেশ, গরম থেকে রক্ষা পেতে বাড়ি-অফিস সব জায়গাতেই শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্র, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদির আবির্ভাব ঘটছে, যা নির্গত করছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন অর্থাৎ বিশ্বউষ্ণায়ন বাড়ছে।
মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপ পরিবেশের জন্য সংকট ডেকে আনছে। সেই সংকটের হাত থেকে মানুষও নিরাপদ নয়। প্রকৃতি নিজেই আর কতদিন সহ্য করবে, এই অত্যাচার?
গাছ প্রকৃতিকে অক্সিজেন দেয়, বিনিময়ে বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাহায্যে চালায় সালোকসংশ্লেষ। পৃথিবীর গভীর বনাঞ্চলগুলিকে এতদিন অক্সিজেনের উৎস হিসাবেই আমরা জানতাম। আমাজন পৃথিবীর ফুসফুস বলে পরিচিত। কিন্তু সব হিসেব এবার উল্টে যেতে চলেছে। ক্রান্তীয় অঞ্চলের বনভূমি আর অক্সিজেনের উৎস তো নয়ই, কয়েক দশকের মধ্যেই এই বনভূমি কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উৎসে পরিণত হতে চলেছে। গবেষণা এমনটাই জানাযাচ্ছে।
অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষছেদন, গোদের উপর বিষফোঁড়া! গত কয়েক বছরে অগ্নিকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে আমাজন, কঙ্গো, সুমাত্রার মাতো ক্রান্তীয় বনভূমিকে। এইসব ঘটনাই দেখিয়ে দিচ্ছে, অরণ্যের চরিত্র বদলাচ্ছে। তবে সেই বদল কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা যে ছিল না; তা বলাই বাহুল্য।
লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইমন লুইসের গবেষণায়, আবহাওয়া পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর গতিপ্রকৃতি সামনে এসেছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, গত তিন দশকে কমেছে বনাঞ্চলে কার্বন অধিগ্রহণের পরিমাণ। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী তিন দশকের মধ্যে জঙ্গলগুলিই হয়ে উঠবে কার্বনের উৎস। ৯০-এর দশকে যেখানে বায়ুমণ্ডলের ১৭ শতাংশ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নিত ক্রান্তীয় বনভূমিগুলি, গত দশকে সেই পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ শতাংশে। এই পরিসংখ্যানেই আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করছেন অধ্যাপক লুইস।
আত্মকের মেঘ রয়েছে ভারতেও, গঙ্গার উৎস গঙ্গোত্রী হিমবাহই সংকটের মুখে। হিমালয়ের হিমবাহ-সংলগ্ন অঞ্চলে ক্রমাগত বাড়ছে ব্ল্যাক কার্বনের পরিমাণ। ওয়াদিয়া ইন্সটিটিউট অফ হিমালয়ান জিওলজির গবেষকদের করা সাম্প্রতিক সমীক্ষায় চিন্তার মুখে গবেষক ও ভূতাত্ত্বিকরা। ২০১৬ সাল থেকে হিমালয়ের ওপর টানা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তাতে উঠে এসেছে ভয়ংকর তথ্য, তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রীষ্মে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মে মাসে ওই অঞ্চলের বাতাসে ব্ল্যাক কার্বনের ঘনত্ব বেড়ে যায়। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে কম থাকে। তখন ব্ল্যাক কার্বনের পরিমাণ পূর্বের পরিমাণের ৪০০গুণ বেশি!
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণ হিসেবে তালিকায় যদি প্রথম হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড, দ্বিতীয় নামটিই আসবে ব্ল্যাক কার্বনের। জীবাশ্ম জ্বালানি এবং বায়োমাসের অসম্পূর্ণ দহনের ফলেই এর উৎপত্তি। এর বিশেষ ক্ষমতাগুলির মধ্যে অন্যতম হল তাপ ধরে রাখা এবং এরা আলো শোষণও করতে পারে নিজের মধ্যে। হিমালয়ের বেশ কিছু অংশে এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রমাদ গুনছেন সবাই। মাটিতে নেমে এলে, ব্ল্যাক কার্বন জমে থাকা তাপ ছড়িয়ে দেয়। ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। হিমালয় অঞ্চলে এই ঘটনা ঘটলে বরফ গলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গিয়েছে।
ক্রমাগত পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে, বদলাচ্ছে জলবায়ুও। জমে থাকা বরফ গলতে আরম্ভ করেছে। হিমালয়ের মতো জায়গায় যদি এই হারে ব্ল্যাক কার্বন বাড়তে থাকে, তবে ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। পাহাড় দূষিত হবেই, নদীগুলোরও অস্তিত্ব সংকটে দেখা দেবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ব্ল্যাক কার্বন নির্গত দেশগুলির মধ্যে ভারত দ্বিতীয়। এই পরিসংখ্যানে বদল আনতে গেলে কেবল নিয়ম-নীতি প্রণয়ন নয়, আমাদেরকেও উদ্যোগ নিতে হবে।
কার্বন থেকে বাংলাও রেহাই পায়নি, বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলার বর্ষার চরিত্রে বদল দেখা যাচ্ছে। মৌসুমী বায়ু প্রবেশ করার পরেও বৃষ্টি কিন্তু অনিয়মিত, রীতিমতো চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্ষার অনুপস্থিতি। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে কার্বনের বিস্তারই এই অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণ; বাতাসে মিশে থাকা লবণকণা দ্রুত মেঘ জমতে সাহায্য করে। অতিরিক্ত কার্বনের সঙ্গে বিক্রিয়ায় লবণকণার চরিত্র বদলে যাচ্ছে। যার ফলে মেঘ তৈরির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। গবেষকদের মতে, পূর্বঘাট পর্বতে ঝুম চাষের প্রভাবে প্রতি বছর প্রচুর পরিমানে ছাই ও কার্বনের কণা উড়ে আসে গাঙ্গেয় উপত্যকায়। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ সেই কার্বনকণা শুষে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাতাসকে সুরক্ষিত রাখে এবং এর ফলেই বর্ষার নিয়মিত প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশের ভারসাম্যকে রক্ষা করতে সুন্দরবন অপরিহার্য্য, সম্প্রতি ঝড় বুলবুলের, ইয়াস, আম্পান ইত্যাদির প্রভাব থেকে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা রক্ষা পেয়েছে এই বনভূমির কারণেই। কলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গের সামনে ঢাল হয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে সুন্দরবন। এই মাত্রতিরিক্ত কার্বনের হাত থেকে রেহাই পেতে সুন্দরবনের বনভূমির বিস্তারে এবং রক্ষায় জোর দিতে হবে, সেইসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে পূর্বঘাট পার্বত্য অঞ্চলের ঝুম চাষে।
এই জলবায়ু এবং পরিবেশ পরিবর্তনকে আটকাতে, কারখানা থেকে কার্বন অপসারণের পরিমাণ কমাতে হবে, চেষ্টা করতে হবে বনভূমির সম্প্রসারণের, অন্যথায় পরিবেশের বিপুল ক্ষতি হবে এবং তার হাত থেকে আমরা রেহাই পাব না। বাতাসে কার্বনের পরিমাণ তো বাড়ছেই, সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ। বায়ুমণ্ডলের গড় উষ্ণতা যে পরিমাণে বাড়ছে তাতে সংকট অনিবার্য, এই সংকটের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় বৃক্ষ এবং অরণ্য রক্ষা।
সাম্প্রতিক সময়ের কথা ধরি, ভারতের মহাসাগরীয় বলয় প্রায় ৯ থেকে ১০ টি ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনিক স্ট্রম দেখেছে। এছাড়াও আরও কিছু ঝড় আসার সম্ভবনা তৈরি হয়েছিল কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছোয়নি। বাংলাও রক্ষা পায়নি ক্ষতির হাত থেকে বুলবুল,ফেনী, ইয়াস, আম্পান! প্রতিবছরই এ জিনিস হচ্ছে, গত দশকে যদি দেখি বাংলায় ছোট বড় ঝড় নিয়ে সংখ্যাটা নেহাত কম না, পাইলিন, হুদহুদ, আয়লা, শুধু নাম করে আর তালিকা দীর্ঘায়িত করতে চাই না। এই সামগ্রিক জলবায়ু পরিবর্তন কিন্তু কোন সিঁদুরে মেঘ নয়! বরং এক ভয়াবহ অশনিসংকেত!
প্রতি বছর ডিসেম্বরে অক্সফোর্ড ঘোষণা করে “ওয়ার্ড অফ ডি ইয়ার”, ২০১৯ সালের শব্দটি ছিল, “ক্লাইমেট এমার্জেন্সি”, জলবায়ু পরিবর্তন যে কতটা মারাত্মক তার ইঙ্গিত সর্বত্রই পাওয়া যাচ্ছে।
সম্প্রতি NASA তার উপগ্রহ থেকে পাওয়া চিত্রের ভিত্তিতে এক অদ্ভুত দাবি করেছে, যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যেভাবে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, তার ফলে সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে গিয়ে প্লাবনের সম্ভবনা এখন আর অনুমান পর্যায়ে নেই; এ এক অনিবার্য্য ভবিষৎ। গত শতাব্দীতেই বিজ্ঞানীরা এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন, সমুদ্রের জলস্তরের কয়েক মিলিমিটার বৃদ্ধিও লক্ষ্য করা গিয়েছে, যা সম্ভবনা কে বাস্তব প্রমান করছে। শেষ দুই দশকে ১০-১২ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে গিয়ে প্লাবনের সম্ভাবনা রয়েছে পৃথিবীর পশ্চিমভাগের মহাদেশ গুলিতে; বিশেষ করে স্টকহোম, সাংহাই, সিডনি,পার্থ ইত্যাদি শহরগুলির চরম বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলির প্রায় সম্পূর্ণ জলের তলায় তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। ভারতের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের অনুমান অনুযায়ী, ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে গুজরাট মুম্বাই এবং কলকাতায়। বিজ্ঞানীরা এই ঘটনার সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছেন ২০৫০ থেকে ২০৮০ সালের মধ্যে এই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে,অর্থাৎ আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যেই মেরু অঞ্চলের প্রায় অধিকাংশ বরফ গলে জলে পরিণত হবে। ইতিমধ্যেই কলকাতার উপকন্ঠে নদীর দু’ধারে ম্যানগ্রোভ বা লবণাম্বু উদ্ভিদের দেখা মিলছে; স্পষ্টতই যা ইঙ্গিত করছে যে সমুদ্রের নোনা জল নদীর মধ্যে ঢুকে পড়ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে, যদি আর উষ্ণতা বৃদ্ধি না পায় এবং সেই হারে যদি পুনরায় দূষণ না হয়, তাও এই বিপর্যয় রোধ করা অসম্ভব। তার প্রধান কারণ গত অর্ধশতাব্দীতে গড় উষ্ণতা ৪ ডিগ্রি থেকে ৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ও পরিবেশে ব্যাপকহারে দূষণ এবং দূষকের উপস্থিতি। এই বিপর্যয় রোধ করার একটি মাত্র উপায় হল আর নতুন করে দূষণ না করে বরং যে দূষণ রয়েছে, যে দূষক রয়েছে; যতটা পরিমাণে, পারা যায় সেটি কম করা। বাতাসে উপস্থিত দূষণের পরিমান কমাতে পারলেই, পরিবেশের উষ্ণতা হ্রাস পাবে যার ফলে প্রকৃতিকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা যেতে পারে।
অভিনব কিছু পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার এই বিপর্যয়ের পরিস্থিতিকে অনেকটাই পিছনে ঠেলে দিতে পারে, কালবিলম্বে আমারাও কিছু কাল সময় পেয়ে যেতে পারি।