সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় চরম আর্থিক সঙ্কটে জন্য দায়ি চীনের ঋণের ফাঁদ! নেপথ্যে আসল কারণ কী?
বাড়ির কাছে আরশিনগর। সেখানে যে পড়শিরা বসত করেন আজ তাঁদের ঘোর দুর্দিন। হ্য়াঁ, এই মুহূর্তে এটুকু বললেই পরিষ্কার যে, শ্রীলঙ্কার (Sri Lanka) কথা বলছি। অবশ্য পাকিস্তানেও প্রধানমন্ত্রীর আসন টলে যাওয়ার ধাক্কায় দেশজুড়ে দারুণ উত্তেজনা। কিন্তু এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার সংকট আরও তীব্র। সেদেশের ২ কোটি ২০ লক্ষ নাগরিকের চোখের সামনে দুলতে দুলতে নেমে আসছে আশঙ্কার কালো পর্দা! মুদ্রাস্ফীতি ও ঋণের (Loan) চাপে দেশকে দেউলিয়া হতে দেখে রাজপথে কাতারে কাতারে নেমে এসেছে মানুষ। যাদের বড় অংশ পড়ুয়া। টিয়ার গ্যাস কিংবা জলকামান ছুঁড়েও তাদের রোখা যাচ্ছে না। এদিকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে সরকার। সব মিলিয়ে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে গত সাত দশকেরও বেশি কালপর্বে সবচেয়ে অন্ধকার সময়ের মুখোমুখি দ্বীপরাষ্ট্র।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, এই দিনের আগমন অবশ্যম্ভাবীই ছিল। বহু বছর ধরেই একটু একটু করে তৈরি হচ্ছিল এই অন্ধকারের আদল। স্বাধীনতার আগেই ইংরেজরা বড় ক্ষতি করে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কার। সেখানকার কৃষি কাঠামোকে বদলে কেবল চা, কফি, মশলা, রবার উৎপাদনের উপযোগী করে তুলেছিল দেশটাকে। স্বাধীনতার পরে প্রয়োজন ছিল সেই পরিস্থিতির বদল। কিন্তু তা হয়নি। অর্থনীতির উপরে থাকা চাপকে কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে না পারার ফলই ভুগতে হচ্ছে আজ। পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে সমস্যায় ফেলেছে পরের পর মরশুম ধরে ভারী বৃষ্টি। এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি রাসায়নিক সারের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করার ফলেও মুখ থুবড়ে পড়েছিল কৃষি।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যায় ২০১৮ সাল থেকে। সেই বছরই শ্রীলঙ্কার ‘চিনপন্থী’ প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংঘেকে পদচ্যুত করেন প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা সিরিসেনা। পরের বছর ইস্টারের সময় চার্চ ও বিলাসবহুল হোটেলে জঙ্গি হামলায় মারা যান বহু মানুষ। এর মধ্যেই ২০২০ সালে এসে পড়ে করোনা অতিমারীর কালো থাবা। পরিস্থিতি হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
এই অবস্থায় আচমকা কর কমানো ও জৈব চাষ চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। দেশে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করে দেওয়া হয়। সমস্ত পণ্য পরিষেবার উপর ২ শতাংশ ‘নেশন বিল্ডিং ট্যাক্স’ নেওয়া হত। সেটাও তুলে দেওয়া হয়। এর ধাক্কাতেই তৈরি হয় আজকের অবস্থা। হু হু করে ঘাটতি দেখা যায় রাজকোষে। ফলে বিদেশি বাজারে প্রবেশের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে শ্রীলঙ্কা। ঋণ মেটাতে বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে বাধ্য হয় সরকার। যার দরুন ২০১৮ সালেই বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার সঙ্কুচিত হয়ে ৬.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে এসে দাঁড়ায় মাত্র ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
‘কলম্বো গেজেট’-এ সুহেল গুপ্টিল লিখেছেন, শ্রীলঙ্কাকে জোড়া বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে। একদিকে বাণিজ্যিক ঘাটতি। অন্যদিকে আর্থিক ঘাটতি। এর মধ্যে গত ২ বছর ধরে চলতে থাকা করোনা পরিস্থিতি বিষয়টিকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। এদিকে ২০১৪ সাল থেকেই ঋণের বোঝা বাড়তে শুরু করেছিল কলম্বোয়। আর এই ঋণের সবচেয়ে বড় অংশটাই চিনের থেকে নেওয়া। আসলে চিনই শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক অংশীদার। তাদের কাছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ রয়েছে শ্রীলঙ্কার। এখানেই শেষ নয়, দেশের আর্থিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে আরও ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ধার করতে হয়েছে পরে। তবে শুধু চিন নয়, সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের মোট পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেই সঙ্গে ক্রমেই মুখ থুবড়ে পড়ে জিডিপি। ২০১৯ সালে তা পৌঁছে যায় ৪২.৮ শতাংশে।
বর্তমান যা পরিস্থিতি তাতে ভোগান্তির শেষ নেই আমজনতার। একে তো জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। দীর্ঘ লাইন দিয়ে কিনতে হচ্ছে সব কিছু। দিনে ১০-১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে বিদ্যুৎ পরিষেবা। বিদ্যুৎ বাঁচাতে অধিকাংশ সময়ে নিষ্প্রদীপ রাজপথ। দিনের মধ্যে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং। যার জেরে সাধারণ পরিষেবাও ঠিকমতো মেলা কষ্টকর। হাসপাতালে অপারেশন পর্যন্ত আটকে যাচ্ছে।
ক্ষোভে ফুঁসছেন সেদেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও। সাধারণ ফল বিক্রেতা থেকে চাল ব্যবসায়ী, সকলেরই দাবি, দেশের সব কিছুই চিনকে বেচে দিয়েছে রাজাপক্ষে সরকার। এখন অন্য দেশের থেকে ঋণ নিয়ে বাঁচতে চাইছে। তাঁদের মতে, আর তা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই দেশ ছাড়ার চেষ্টা করতেও দেখা গিয়েছে অনেককে। বাকিরা সকলেই সংশয় ও উৎকণ্ঠাকে সঙ্গী করে দিন গুজরান করছেন।
তাহলে সত্য়িই কি আর উপায় নেই? বিশেষজ্ঞরা অবশ্য ইতিহাস ঘেঁটে দেখছেন ছয়ের দশকেও প্রায় একই ধরনের সংকটের মুখে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা। সে যাত্রায় রক্ষা করেছিল আইএমএফের বিরাট ঋণ। এবারও আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের মুখাপেক্ষী কলম্বো। পাশাপাশি চিন ও ভারতের কাছেও অনুরোধ করেছে প্রশাসন। ভারত তো ইতিমধ্যেই সাহায্য়ের হাত বাড়িয়েই দিয়েছে। মার্চেই ১ বিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্য করেছে ভারত। তবে কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের দাবি, এতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। বরং যে সমস্যা এখন রয়েছে, আগামিদিনে তা আরও বড় আকার নিতে পারে। ফলে আমজনতা আর ঘরে বসে থাকতে রাজি নয়। একে তো গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য এর মধ্যেই ঘাড় নিচু করে কাজ করে যেতে হচ্ছে। আবার সময় বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে রেশন কিংবা তেলের দীর্ঘ লাইনে। এইভাবে তাঁরা আর বেঁচে থাকতে চান না। নতুন দিনের স্বপ্ন নিয়ে তাই পথে পথে মানুষের জটলা। ‘পথে এবার নামো সাথী’র মতো কোনও এক মন্ত্রে সুদিন আনতে উন্মুখ সাধারণ মানুষ। তেমন কোনও বিপ্লব কি আসবে? আপাতত শ্রীলঙ্কার দিকেই চোখ বিশ্বের।