বাকরখানি, যে রুটির সঙ্গে মিশে রয়েছে প্রেমের গল্প
সৌভিক রাজ
শুরু হয়ে গিয়েছে রমজান মাস। রমজান একটি আরবি শব্দ। এই মাসেই ইসলাম ধর্মের পঞ্চমস্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি হিসেবে বিবেচিত হওয়া রোজা পালন করা হয়। রোজাকে আরবি ভাষায় ”সাওম’ বলা হয়। যার অর্থ বিরত থাকা; এর বহুবচন হল ‘সিয়াম’। ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলায় সাওমকে ‘রোজা’ বলা হয়। একই সঙ্গে উপবাসকে পারসি ভাষায় ‘রোজা’ বলা হয়। ভারতে পারসি প্রভাব বেশি হওয়ার কারণে এদেশে রোজা শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়। মুসলমানরা ফজরের নামাজের মাধ্যমে রোজা শুরু করেন এবং সূর্যাস্তের পর উপবাস ভঙ্গ করেন। সূর্য ওঠার আগে নামাজের পর ‘সেহরি’ খেয়ে উপবাস শুরু করতে হয়। সারাদিন নির্জলা উপবাস রেখে সন্ধ্যাবেলার সূর্য ডুবলে, আজানের পর ইফতারের মাধ্যমে উপবাস ভঙ্গ করার নিয়ম।
পবিত্র রমজান মাসে অনেকেই রোজা রাখেন এবং রোজা ভাঙার পরেই শুরু হয় ইফতারের খাওয়া দওয়া। বিরিয়ানি, কাবাব, শরবত, হালুয়া ছাড়াও ইফতারের সঙ্গে মিশে থাকে আরও অনেক খানা।
বাকরখানি :
ঈদের দাওয়াত হোক বা রমজানে রোজা শেষে ইফতার, বাকরখানি ছাড়া অসম্পূর্ণ; তাই বাকরখানি বাধ্যতামূলক। মাংসের বিভিন্ন পদের সাথে, বাকরখানি খাওয়ার রেওয়াজ! বাকরখানির এমন এক খাবার যাঁর সাথে রয়েছে একটি অসম্পূর্ণ প্রেমের গপ্পো, কোন সিনেমার থেকে কোন অংশে কম নয়! একেবারে সত্য ঘটনা।
ইসলামী ঘরানার, বাংলায় এই খাবারটির জন্ম হয় মুসলিমদের হাত ধরে। বাকরখানি! কাশ্মীর, লক্ষ্ণৌ, হায়দরাবাদ, ঢাকার মতো শহরে এর অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তা এবং খাবার হিসেবে প্রচল থাকলেও, এখন কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট, খিদিরপুরের হাতে গোনা দোকানে মেলে মুঘল ঘরানার শুকনো রুটি জাতীয় এই উপাদেয় খাবার। অথচ বাংলার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত ‘বাকরখানি’-র নাম। প্রায় আড়াইশ’ বছরের অতি প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক এই বাকরখানি। জনশ্রুতি অনুসারে, জমিদার আগা বাকের তথা আগা বাকির খাঁর নামানুসারে এই রুটির নামকরণ করা হয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী এই বাকরখানি তৈরির পেছনে রয়েছে এক অমর প্রেমকাহিনী। নামকরণের গল্পটাও বেশ দারুণ। আগা বাকের নামে তুর্কিস্তানের এক বালক ক্রীতদাস হয়ে এসেছিল এদেশে। তখনকার বাংলার সুবেদার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সুদর্শন এই বালককে কিনে নিয়েছিলেন। আগা বাকেরের বুদ্ধিমত্তায় এবং মেধায় মুগ্ধ হয়ে নবাব তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। আগা বাকের প্রথমে চট্টগ্রামে ফৌজদারের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় তিনি চন্দ্রদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন। তার নামানুসারে, বাকেরগঞ্জ জেলার নামকরণ হয় যাকে আমরা এখন বরিশাল নামে চিনি।
নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর আগা বাকেরকে দত্তক নেন বলেও শোনা যায়। প্রখর মেধার অধিকারী আগা বাকের যুদ্ধবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম এবং আগা বাকের পরস্পরের প্রেমে পড়েন। উজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খান, খনি বেগমকে প্রেম নিবেদন করলে তিনি জয়নাল খানকে প্রত্যাখান করেন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়নাল খনি বেগমের ক্ষতির চেষ্টা করে এবং খবর পেয়ে বাকের সেখানে যান ও তলোয়ারবাজিতে জয়নালকে পরাজিত করেন, অন্যদিকে জয়নালের দুই বন্ধু উজিরকে মিথ্যা খবর দেয় যে, বাকের জয়নালকে হত্যা করেছে। উজির ছেলের হত্যার বিচার চায়। নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। অবশেষে বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ। ইতিমধ্যে জয়নালের মৃত্যুর মিথ্যা খবর ফাঁস হয়ে যায় এবং সে জোর করে বলপূর্বক খনি বেগমকে ধরে নিয়ে পালিয়ে দক্ষিণ বঙ্গে। খনি -কে উদ্ধার করতে যান বাকের। পিছু নেন উজির জাহান্দার খান। ছেলে জয়নাল খান বাকেরকে হত্যার চেস্টা করলে উজির নিজের ছেলেকে হত্যা করেন তলোয়ারের আঘাতে। এই অবস্থাতে জয়নাল খনি বেগমকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে। মতান্তরে পরাজিত হয়ে খনি বেগমকে হত্যা করে,নিজে আত্মহত্যা করেন জয়নাল। এই গল্পেরও প্রচার আছে। বাকেরগজ্ঞে সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। বাকের সবকিছু ত্যাগ করে থেকে যান প্রিয়তমার সমাধির কাছে দক্ষিণ বঙ্গে। বাকের খাঁর নামানুসারেই বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ (পটুয়াখালি-বরিশাল) অঞ্চলের নাম হয় বাকেরগঞ্জ। ঐতিহ্য্যবাহী বাকরখানি রুটির নামের পেছনে রয়েছে বাকের-খনির প্রেমের ইতিহাস।
নামকরণের ব্যাপারে অন্য একটি জনশ্রুতি রয়েছে। সে অনুযায়ী, মির্জা আগা বাকের ঢাকায় বাকরখানি রুটি প্রচলন করেন। তিনি বৃহত্তর অবিভক্ত বরিশালের জায়গীরদার ছিলেন। তার প্রেয়সী ছিল আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম। তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ছিল বলে কথিত আছে। পরবর্তীতে আগা বাকের মুর্শিদকুলি খাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। কিন্তু খনি বেগমের স্মৃতি তিনি ভুলে যান নি।তাই তার প্রিয় খাদ্য বিশেষভাবে তৈরি এই রুটির, নাম তার প্রেমকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নামকরণ করা হয়েছিল বাকের-খনি রুটি। কিংবদন্তি অনুযায়ী, এটি আঠারো শতকের ঘটনা।
আরেকটি ঘটনা অনুযায়ী, বাকেরের কোলে মাথা রেখেই মার যান খনি বেগম। প্রেমের স্মৃতিচিহ্ন রেখে যেতে আগা বাকের নতুন ধরনের শুকনো রুটি তৈরি করিয়ে তার নাম দিয়েছিলেন বাকেরখনি। সাধারণ মানুষের উচ্চারণে যা আজ বাকরখানি হয়ে গেছে। নবাবদের এই খাবার বাকরখানি; অতীতে ময়দার সঙ্গে দুধের মালাই ও মাখন মিশিয়ে তৈরি করা হতো। প্রাচীন কালে বাকরখানি ছিল নবাব আর ধনীদের প্রিয় খাবার। মালাই-মাখনের বাকরখানি এখন আর পাওয়া যায় না, বর্তমানে ময়দা দিয়ে গোলাকার কাঁচা রুটি তৈরি করা হয়। কাঁচা রুটির মাঝখানে ছুরি দিয়ে লম্বা করে তিনটি দাগ কেটে দেওয়া হয় এবং একপাশে জলের সামান্য প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেওয়ালে লাগিয়ে দেওয়া হয়। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় বাকরখানি। বাকরখানি সাধারণ রুটির তুলনায় মোটা এবং শক্ত; আজকাল বিভিন্ন আলাদা আলাদা উপকরণ ব্যবহার করেও নানান রকমের বাকরখানি তৈরি করা হয়।