বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

কুমির পুজোর মাধ্যমে ৭০০ বছরের ঐতিহ্য আজও বেঁচে আছে মাকড়দহের নিমেরহাটিতে

April 14, 2022 | 3 min read

বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে লোকায়ত দর্শন, এ রাজ্যের লৌকিক ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বাংলায় নানান ধরণের ঈশ্বরের আরাধনা করা হয়। প্রকৃতি, পশুপাখি, এমনকি বাংলার কোন কোন জায়গায় মানুষের উপরেও দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। তেমনই এক বিচিত্র দেবতার কথা জানব আজ।

বাংলার একাধিক প্রবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে কুমির। বাংলা জুড়ে জলের রাজাকে নিয়ে বহু গল্পকথা, মিথ, জনশ্রুতি ছড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে নানান উপাখ্যান। তেমনই এক অনন্য উপাখ্যানেরই হদিশ মিলল হাওড়ার মাকড়দহের নিমেরহাটিতে। এখানকার মানুষ কুমিরকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করেন। পাঁচটা গ্রাম মিলিয়েই আয়োজিত হয় এই পুজো। চৈত্র সংক্রান্তি তিথিতে নিজস্ব রীতি মেনে ‘তিনি’ পূজিত হন। বৈশাখে হয় গৃহে গমন। 

লৌকিক দেবদেবীদের সঙ্গে রাজ্যের লোকসংস্কৃতির যোগাযোগ অবিচ্ছেদ্য। ডোমজুড়ের কাছেই অবস্থিত মাকড়দহের নিমেরহাটির কুমির পুজোও বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির নজির হয়ে গিয়েছে। কুমির সরাসরি লৌকিক দেবদেবীর তালিকায় না পড়লেও, সাতশো বছর আগে স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে তা সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। এই পুজো স্থানীয় ‘বাস্তু থান’ চড়ক উৎসবের অংশ।

এই পুজো প্রচলনের নেপথ্য রয়েছে এক কাহিনী। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী, শিবপুরের চৌধুরী জমিদারদের কাছ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে নিমেরহাটির কয়েকশো বিঘা জমি ১০ টাকা ১৪ আনায় কিনেছিলেন রামকান্ত নস্কর। তাঁর হাত ধরেই বাস্তু থানের চড়ক উৎসবের প্রচলন হয়। কুমির পুজোরও শুরু তখন থেকেই। প্রবীণ শিক্ষক তথা রামকান্তর বংশধর কমলকৃষ্ণ নস্কর বলেন, ‘পূর্বপুরুষদের মুখে শুনেছি, সেই সময় গোটা এলাকাই ছিল নিচু, জলা জমি। পাশ দিয়ে বইত সরস্বতী নদী। ফলে কুমিরের উৎপাত ছিলই। সেই আতঙ্ক থেকেই কুমিরকে সন্তুষ্ট করতে রামকান্তবাবু চড়কের দিন কুমির পুজোর সূচনা করেন। এখন শরিকদের বছরে একবার করে পালা পড়ে। যাঁদের পালা, তাঁদের একজনকে সন্ন্যাসী হিসেবে মনোনীত করা হয়। তিনি নিজের হাতেই গড়েন কুমিরের মূর্তি।’

অন্যদিকে, তিন পুরুষ ধরে চড়কের দিনেই কুমির পুজো করেন তপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘এক সময়ে একটি কুমির পাড়ে এসে যেভাবে শুয়েছিল, সেই দৃশ্যকেই মূর্তি হিসেবে তুলে ধরে পুজো করা হয়। মূল সন্ন্যাসীর নামে সংকল্প করে সূর্য মন্ত্রে পুজো করা হয় কুমিরকে। পুজোর পরে সেই মূর্তি ভেঙে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।’ 

তবে কালের নিয়মে সমাজের অগ্রগতির দাপটে এই পুজোর জৌলুস বেশ কিছুটা ম্লান হয়েছে। যদিও স্থানীয়রা আজও চান শত শত বছরের এই রীতি অক্ষত থাক। বজায় থাকুক ঐতিহ্য। স্থানীয় বাসিন্দা বিশ্বজিৎ নস্করের কথায়, ‘কুমির পুজো আমাদের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। যা স্থানীয় সংস্কৃতির পরিচয়ও বটে। কুমির পুজোর পাশাপাশি আমাদের এখানে মূল চড়ক হয় পয়লা বৈশাখ। এটাও ব্যতিক্রমী রীতি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই লোকাচারকে ধরে রাখার পাশাপাশি একে প্রচারের আলোয় আনলে হারানো জৌলুস আবার ফিরে আসবে।’

একদা গ্রাম নিমেরহাটি, আজ মফ:স্বলে পরিণত হয়েছে। সরস্বতী নদীও মজে গিয়েছে, আজ প্রায় নেই বললেই চলে। স্বভাবতই কুমিরের আতঙ্কও আজ আর নেই। কিন্তু তাতেও কুমির পুজোর নিষ্ঠায় এক ইঞ্চিও ভাটা পড়েনি। প্রভাতী প্রসাদ থেকে সন্ধ্যা প্রদীপ, আজও ভক্তিভরে তিন দিন কুমির মূর্তির সামনে পুজো দেন গ্রামের মহিলারা।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Makardah, #Nimerhati, #Crocodile pujo

আরো দেখুন