উদ্ভিদেরও স্নায়ুতন্ত্র আছে, জগদীশ বসুর পর যুগান্তকারী আবিষ্কার তিন বাঙালি গবেষকের!
গাছেরও প্রাণ আছে। বিগত শতাব্দীর শুরুতে সেই প্রমাণ দিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন বরেণ্য বাঙালি পদার্থবিদ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। সেই গবেষণার ধারাকে আরও একধাপ এগিয়ে দিলেন তিন বাঙালি গবেষক। প্রাণীর মতো স্নায়ুতন্ত্র না থাকা সত্ত্বেও বাহ্যিক উদ্দীপকে উদ্ভিদের দেহে সঙ্কেত গ্রহণ ও প্রবাহের রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন তাঁরা। আর সেই প্রক্রিয়ার জৈব রাসায়নিক পদ্ধতি মানুষের চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়। তাকে ‘উদ্ভিদ স্নায়ুতন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করাই যায়, যে তত্ত্ব প্রথম দিয়েছিলেন চার্লস ডারউইন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষক অন্তরা সেনগুপ্ত, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অ্যাপ্ল্যায়েড স্ট্যাটিসটিক্স বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক পবিত্র পালচৌধুরী এবং নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের বটানি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শুভদীপ চক্রবর্তী এই গবেষণার পিছনে রয়েছেন। বিশ্ববিখ্যাত একটি জার্নালের তরফে তাঁদের এই গবেষণাপত্রটির স্বীকৃতি পাওয়ার চিঠি শনিবারই পেয়েছেন বাঙালি ত্রয়ী। দ্রুত তা প্রকাশিত হবে।
বাহ্যিক যে কোনও স্টিমুলাস (উদ্দীপক) মানুষ গ্রহণ করে বিশেষ কিছু রিসেপ্টর বা গ্রাহকের মাধ্যমে। সেরকম ২১টি প্রোটিন চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। গবেষণার জন্য উদ্ভিদ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল অ্যারাবিডপসিস থালিয়ানাকে। দেখা গিয়েছে, এই ধরনের রিসেপ্টর প্রোটিন ওই উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে ১৯টি। যে কোনও প্রোটিনই অ্যামাইনো অ্যাসিডের শৃঙ্খল দিয়ে তৈরি। মানুষের শরীরে থাকা রিসেপ্টর প্রোটিনগুলির অ্যামাইনো অ্যাসিড শৃঙ্খলের সঙ্গে উদ্ভিদের ওই অংশের শৃঙ্খলগুলির অদ্ভুত মিল। আঘাত, তাপ, চড়া আলো প্রভৃতি বাহ্যিক উদ্দীপকগুলি গ্রহণের জন্য মানুষের শরীরে থাকে আয়নোট্রপিক গ্লুটামেট রিসেপ্টর। উদ্ভিদের শরীরেরও একই ধরনের গ্লুটামেটধর্মী গ্রাহক রয়েছে। বাহ্যিক স্টিমুলির সঙ্কেত গ্রহণ ছাড়াও উদ্ভিদের শরীরে সেগুলি স্টোমাটাল রেগুলেশন (কচি কাণ্ড বা পাতার ত্বকাবরণীতে থাকা আণুবীক্ষণিক ছিদ্রের নিয়ন্ত্রণ), পোলেন টিউবের বৃদ্ধি প্রভৃতির জন্য দায়ী থাকে। আর মানুষের শরীরের যে ‘গাবা’ রিসেপ্টর থাকে, উদ্ভিদের শরীরেও সেরকম অ্যালুমিনিয়াম জাত ট্রান্সপোর্টার থাকে, যা উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
উদ্ভিদ এবং মানুষ বা স্তন্যপায়ী প্রাণীরা সৃষ্টির পর থেকে পৃথক বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও দু’টি জীবের মধ্যেকার সঙ্কেত গ্রহণ এবং পরিবহণ প্রক্রিয়ায় অদ্ভুত মিল দেখে অবাক হয়ে গিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেগুলির অ্যামাইনো অ্যাসিড, প্রোটিনের গঠন এবং অন্যান্য জৈব-রাসায়নিক মিল রয়েছে। অর্থাৎ প্রমাণিত হল, কাটলে বা পুড়িয়ে দিলে গাছ একইভাবে উদ্দীপক আকারে সেই সঙ্কেত গ্রহণ করে। মস্তিষ্কের ধারণা না থাকায় গাছ সেইসব নেতিবাচক স্টিমুলিতে বিচলিত হয় কি না, তা গবেষণাসাপেক্ষ। তবে, উদ্দীপকের মাধ্যমে উদ্ভিদের শরীরের যে বিভিন্ন পরিবর্তন হয়, সেসব প্রমাণিত। যেমন, আলোর মতো উদ্দীপক উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং চলন নিয়ন্ত্রণ করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ বা প্রাণীর মতো স্নায়ুতন্ত্র থাকলে উদ্ভিদ নিজে থেকে ডালপালা নেড়েও এই বাহ্যিক উদ্দীপকে সাড়া দিতে পারত। এই আবিষ্কার মানব, উদ্ভিদদেহ আরও ভালোভাবে বোঝার ক্ষেত্রে নতুন দরজা খুলে দেবে বলে বিজ্ঞানীদের আশা।