মা-বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্কের টানাপোড়েন – ফুটে উঠেছে রুপোলি পর্দায়
সৌভিক রাজ
আজ ১৯ই এপ্রিল। সিনেমার ইতিহাসে অমর এই তারিখটি। প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত এই ছবিতে উঠে এসেছে সম্পর্কের টানাপোড়েন। মা এবং মেয়ে সম্পর্কের সমীকরণ একরকম আঙ্গিকে দেখতে আমরা অভ্যস্ত; সেই সম্পর্কের সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিক দেখিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। অপর্ণা সেন ও দেবশ্রী রায়ে অভিনয় নজর কেড়ে ছিল।
এর আগেও বাংলা ছবিতে একাধিকবার বাবা-মা-সন্তানের সম্পর্কের সমীকরণ উঠে এসেছে। হালের ছবিগুলোতেও আসছে। সমাজের প্রকৃতি চিত্রকে তুলে ধরাই চিত্রনির্মাতাদের কাজ। যুগের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ চিত্রও বদলে যায়। থেকে যায় কাজগুলো।
বাবা-মা-সন্তানের সম্পর্ক সিনেমার পর্দায় বারবার উঠে এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। এমন কিছু ছবির হদিশ করল দৃষ্টিভঙ্গি:
১) অপুর সংসার :
এই ছবি সাম্প্রতিক ছবি নয়, কিন্তু বিভূতিভূষণের কাহিনীকে ভিত্তি করে সত্যজিতের এই সৃষ্টিতে ধরা দিয়েছে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক। অপু ট্রিলজির শেষ ছবি অপুর সংসার, ছবিটি ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায়। গোটা পৃথিবীর দর্শকের কাছে সমাদৃত এই ছবিতে অপুর সংসার জীবন দেখানো হয়েছে। সৌমিত্র এখানে একেবারে সাধারণ এক যুবক। যে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। ভাড়া বাড়িতে থাকা, চাকরি খোঁজা, অপর্ণার সঙ্গে বিয়ে, আর্থিক সমস্যা, কাজলকে জন্মদিতে গিয়ে অপর্ণার মৃত্যু, তারপর অপুর বোহেমিয়ান জীবনের শুরু এবং সেখান থেকে পিতা পুত্রের বন্ধুত্ব-এর সম্পর্কে শেষ হয় ছবি। মনে পড়ে সেই দৃশ্য তুমি যাবে আমার সঙ্গে? তুমি কে? আমি…আমি বন্ধু। বাবা ছেলের মিলনের এমন দৃশ্য ভারতীয় সিনেমায় তদানিন্তন সময় বিরল, আজ তা খুব বেশি দেখা যায় না। এক তরুণের বাবা হওয়া এবং ছেলে কাজলের বন্ধু হওয়ার গল্প বলে ছবি। ছেলেকে আঁকড়েই নতুন করে বাঁচা শুরু হয় অপুর।
২) আবহমান :
ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত চলচ্চিত্রটি ২০১০ সালে মুক্তি পায়। দীপংকর দে, মমতা শঙ্কর, যীশু সেনগুপ্ত, অনন্যা প্রমুখেরা অভিনয় করেন। ছবিটিও এক পরিবারের গল্প বলে। বাবার অবৈধ প্রেমের কারণে ছেলের প্রতিক্রিয়া কি হয়, কীভাবে বাবা মা ছেলের গল্প মোড় নেয় তাও দেখানো হয়। ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার জিতে নেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
৩) অসুখ :
১৯৯৯ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। বাবা-মেয়ের গল্প নিয়ে এই ছবি। তারকা মেয়ে ও তার সাধারণ বাবা মা-কেই নিয়েই গল্প বোনেন ঋতুপর্ণ। সৌমিত্র অভিনয় অপূর্ব। ছবিতে মায়ের অসুস্থতা, জীবনের গতিশীলতায় বাবা-মেয়ের দূরত্ব বাড়ে।
৪) সাঁঝবাতির রূপকথা :
এটিও এক বাবা-মেয়ের গল্প। সৌমিত্র-ইন্দ্রানী হালদার অভিনয় করেন বাবা মেয়ের ভূমিকায়। শিল্পী বাবার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে মা ও মেয়ে সরে আসেন বাবার জীবন থেকে। বাবা একা হয়ে পড়েন, একাকীত্বের থেকে গ্রাস করে শিল্পীসত্ত্বাকে। শেষে ফিরে আসে মেয়ে।
৫) বালিগঞ্জ কোর্ট :
২০০৭ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। এই ছবিতে ধরা দেয় বাবা ছেলের গল্প। কার্যত বৃদ্ধাবাসে পরিণত হওয়া এক আবাসন। ছুটে চলা সমাজের সঙ্গে পাল্লা দিতে বাবা-মাকে ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দেয় ছেলে। অনিচ্ছুক বাবা গুমড়ে মরে, মায়ের মৃত্যুর খবরও সে ছেলেকে দেয় না। শেষে মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে ফিরে আসে ছেলে, বাবা ছেলে মিলন হয়। সৌমিত্র-ভাস্বর জুটির অভিনয় মুগ্ধ করে।
৬) তিতলি :
তিতলি ছবিটি এক তরুণীর, তরুণীটির নাম তিতলি। তার জীবনের গল্পই এই ছবি। চলচ্চিত্র জগতের তারকাকে ভালবাসে তিতলি, হঠাৎ করে একই গাড়িতে ওই চিত্রতারকার তাদের সঙ্গে সফর করে। এর মধ্যে তিতলি জানতে পারে তার মায়ের প্রেমিক ওই অভিনেতা, তারপরেই ঘটে পরবর্তন। মা, মেয়ের একই পুরুষের প্রতি জীবনের কোন না কোন সময় আকর্ষিত হওয়ার এই ঘটনাকে অনন্য উপাখ্যানের মোড়কে মুড়েছেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ।
৭) ইচ্ছে :
এই ছবিতে বয়সন্ধির সমস্যা উঠে এসেছে। কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্র জীবনের সমস্যা এসেছে, মায়ের ভূমিকায় সোহিনী সেনগুপ্তের অভিনয় ছবিকে অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। ২০১১ সালে ছবিটি তৈরি করেন শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটি। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করেই ছবিটি নির্মিত হয়েছে।
৮) পোস্ত :
বাস্তব এক ঘটনা থেকেই এই ছবি তৈরি হয়েছে। একে তিন প্রজন্মের গল্প বলা চলে। নাতির অভিভাবকত্বের অধিকার নিয়ে বাবা ছেলের লড়াই, বর্তমান সময়ের সমাজ সমস্যার একটি দিক তুলে ধরে। সৌমিত্র-যীশুর অভিনয় ছবিকে স্মরণীয় করে রেখেছে। এই ছবিটিও শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটির সৃষ্টি। এই পরিচালক জুটির বেলাশেষে ছবিটিও সম্পর্কের টানাপোড়েনকে তুলে ধরে, জীবনের প্রান্ত সময় এসে বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হয়, কতকটা স্বেচ্ছা বিচ্ছেদ। যা আলোড়ন সৃষ্টি করে সন্তানদের মাঝে, সন্তানদের শেষ হতে বসা সম্পর্কগুলো নতুন করে অক্সিজেন পায়। ছেলে মেয়েরা উপলব্ধি করে সম্পর্কের মূল্য।
৯) জেনারেশনে আমি :
খুবই প্রচলিত একটি বাক্য, “এই প্রজন্মের দ্বারা কিছুই হবে না!” এই মিথকে ঘিরে বাবা মা ও আজকের যুগের এক সন্তানের কথা দেখানো হয়। মৈনাক ভৌমিকের ছবিটি সত্যিই তরুণ প্রজন্ম ও তাদের বাবা মায়ের সমস্যাকে তুলে এনেছে। প্রত্যাশা পূরণের চাপ যে কী মারাত্মক তা উপলব্ধি করায় এই ছবিটি। ঠিক তেমনই একটি ছবিটি হয়েছিল চলো পাল্টাই। প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই ছিল এই ছবিটি।
১০) ময়ূরাক্ষী :
বাবা ও ছেলের সম্পর্কের এমন গভীর সংকট ও স্পর্শকাতরতা নিয়ে আগে কোনও বাংলা সিনেমা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। স্মৃতিভ্রংশে আক্রান্ত বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অতনু ঘোষের ‘ময়ূরাক্ষী’ ছবিতে তাঁর আত্মজর চরিত্রে অভিনয় করলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। প্রবাসী ছেলে বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে অল্প কিছুদিনের ছুটি নিয়ে চলে আসে। তাঁর ধারণা ছিল বাবাকে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে দিয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়ে ওঠার নয়। ছেলে বুঝতে পারে বাবার অসুস্থতার পেছনে রয়েছে মানসিক কারণ। তিনি পঁচিশ বছর আগের ছাত্রী ‘ময়ূরাক্ষী’কে ভুলতে পারেননি। যার সঙ্গে নিজের ছেলের বিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। বাস্তবে তো তা হয়নি! বাবা-ছেলের এক স্পর্শকাতর আবেগী গল্প ময়ূরাক্ষী।