বাণিজ্য সম্মেলনে শিল্পপতিরা একমত, বাংলাই পথ দেখাবে দেশকে
বাংলায় চলছে বিশ্ববাংলা বাণিজ্য সম্মেলন, দেশ-বিদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে হাজির শিল্পপতিরাও। প্রত্যেকেই বাংলায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। সকলের গলাতেই শোনা গেল বাংলা নিয়ে প্রশংসা।
জেএসডাব্লু গ্ৰুপের চেয়ারম্যান সজ্জন জিন্দাল বলেন, “বাংলা এই দেশের সবচেয়ে উন্নত ও ধনী প্রদেশ ছিল। সময়ের সাথে নীতি বদলে বাজারের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে বাংলা। জগৎ সভায় আবার শ্রেষ্ঠ আসন লবে বাংলা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মন্দির তৈরি হচ্ছে মায়াপুরে। সেখানে ৭০০ একর জমি দিয়েছে রাজ্য সরকার। শালবনীতে আমাদের স্টিল প্লান্ট আগামীদিনে আরও বড় হবে। আমরা এই রাজ্যে কোনও শ্রমিক সমস্যা বা শ্রমদিবস নষ্টের সম্মুখীন হইনি।”
আরেক শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েঙ্কার মতে, কলকাতা বাস করার পক্ষে এক আদর্শ জায়গা, ব্যবসা করার পক্ষে সেরা গন্তব্য। তাঁর কথায়, “১০-১২ বছর আগেও বার্ষিক ৭০-৮০ লক্ষ শ্রম দিবস নষ্ট হত নানা সমস্যার কারণে। গত কয়েক বছরে সংখ্যাটা শূন্য। এই সরকার প্রগতিতে বিশ্বাস করে। এগিয়ে যেতে চায়। গত কয়েক বছরে আমি রাজ্যের পরিকাঠামো উন্নয়নে ২২,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। এক দশক আগে এক হতাশা গ্রাস করেছিল বাংলাকে। এই রাজ্য থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন অনেকেই। তারপরেই রাজ্যে ক্ষমতায় এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”
আইটিসির চেয়ারম্যান সঞ্জীব পুরী বলেন, “বাংলায় পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দুই হোটেল আইটিসি সোনার বাংলা আর আইটিসি রয়াল বেঙ্গল বাংলার প্রতি আমরা উৎস্বর্গ করেছি। গত কয়েক বছরে বাংলায় আমাদের বিনিয়োগ ত্বরান্বিত হয়েছে। সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণেই সম্ভব হয়েছে। এক শতাব্দী ধরে আমাদের ব্যবসার পীঠস্থান কলকাতা। আমরা গর্বিত। বিগত কয়েক বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলায় ব্যাপক প্রগতি করেছে।”
ভুটানের প্রতিনিধি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের খুব কাছেই রয়েছে ভুটান। আমাদের ৯০ শতাংশ ব্যবসা ভারতের সাথেই। এর মধ্যে ভুটান ৬০ শতাংশ বাণিজ্য বাংলার সাথেই করে।”
উইপ্রোর এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান রিশাদ প্রেমজি তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলার উন্নয়নের জন্যে বাংলাকে কুর্নিশ জানিয়েছে। তিনি বলেন, “বাংলার সাথে আমাদের সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিশ্চিতভাবে, সামাজিক খাতে বাংলা অভূতপূর্ব কাজ করেছে।” রাজ্যের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুফল সমাজের সব মানুষ পাবেন, বলেই মত তার।
সিআইআই-এর সভাপতি, তথা টাটা স্টিলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর টিভি নরেন্দ্রন বলেন, এক দশক আগে আমি বাংলায় বিনিয়োগ করার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। সেই তিনিই আজ বাংলায় বিনিয়োগের আগ্রহী। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে সিআইআই কাজ করছে। রাজ্য সরকারের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা মধুর, বলেই ব্যাখ্যা করেন টিভি নরেন্দ্রন। খড়গপুরে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিআইআই-এর বর্তমান ইউনিটের সম্প্রসারণ হচ্ছে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সীর মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্বাচিত করে মানুষ ভুল করেনি। বাংলা আরও এগিয়ে যাবে।
নিরঞ্জন হীরানন্দানি বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে কলকাতার ব্যাপক বদল হয়েছে। সিটি অফ জয় আজ সিটি অফ বিজনেস হয়েছে। হীরানন্দানির সংস্থা বাংলার ৫ জেলায় পাইপবাহিত গ্যাস পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করছে। বাংলায় তারা শীঘ্রই একটি ডাটা সেন্টার তৈরি করেব। যে কারণে বাংলায় ১৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। তাঁর কথায়, অতিমারির সময় যখন বিশ্বজুড়ে ব্যবসা ধাক্কা খেয়েছিল, বাংলার অর্থনীতি সেই করোনা কালেই ৭ শতাংশ পৌঁছেছিল, যা চমকপ্রদ।
তবে আজকের বাণিজ্য সম্মেলনে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ছিল গৌতম আদানির উপস্থিতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কয়েক মাস আগেই নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন আদানি গোষ্ঠীর কর্তা তথা গৌতমের ছেলে করণ। সেই সময়েই বাবাকে নিয়ে কলকাতায় বাণিজ্য সম্মেলনে আসার আমন্ত্রণ জানান। সেই কথা রেখেছেন করণ এবং গৌতম। সেই সঙ্গে আগামী ১০ বছরে রাজ্য বড় অঙ্কের বিনিয়োগের কথা দিয়ে গেলেন তিনি।
আদামী দশ বছরে বাংলা দশ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে আদানি গোষ্ঠী। ২৫ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হবে। কলকাতায় বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এমনই প্রতিশ্রুতি দিলেন আদানি গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানি। আদানি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়, রাজ্যের সরকার এবং রাজ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের ভূয়সী প্রশংসাও করেন।
সম্মেলনের প্রথম দিনে একেবারে শেষে বক্তব্য রাখেন আদানি। সংগ্রাম থেকে নবজাগরণে বাংলার ভূমিকার উল্লেখ করেন। রাজ্য নারী ক্ষমতায়ণে কী ভাবে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে তার বিবরণ দিতে গিয়ে মমতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘আপনি সেই ঐতিহ্য সগৌরবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এই রাজ্য় একটি বদ্বীপের মতো। আর আপনি সেই রাজ্যে শিল্প, সংস্কৃতি, প্রশাসনিক দক্ষতার মিশেলে এক বদ্বীপের মতোই। আপনার জনপ্রিয়তার কোনও তুলনা নেই। আমার মধ্যে যে ক্যারিশ্মা রয়েছে তা অসাধারণ।’’
রাজ্যে আদানি গ্রুপ কী কী ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারে তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন আদানি। একটি ডেটা সেন্টার নির্মাণ করতে চান বাংলায়। সমুদ্রের নীচে কেবল পাতার লক্ষ্য রয়েছে। এ ছাড়াও ওয়্যারহাউজ, লজিস্টিক পার্ক তৈরির লক্ষ্য রয়েছে আদানি গ্রুপের। সংস্থার অধীন আদানি উইলমার গ্রুপের ফরচুন সরষের তেলের উৎপাদন বাড়াতে চান বলেও জানান গৌতম।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলনের প্রথম দিনেই প্রমাণিত হল যে, বাংলা মানেই বাণিজ্য আর লগ্নির জন্য দেশের প্রথম সারির ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য এখন বাংলা।