তীব্র দাবদাহ তবু কলকাতায় কেন অধরা বৃষ্টি? কী বলছে আবহবিদরা?
কখনও নির্ধারিত সময়ের থেকে দীর্ঘায়িত শীতকাল, তো কখনও অসময়ের বৃষ্টিতে ভাসছে কলকাতা। এ বছর এপ্রিল শেষ হতে চললেও এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েনি শহরে, হয়নি কালবৈশাখীও। শুধু এপ্রিল নয়, গত ৫৫ দিন ধরে বৃষ্টি নেই কলকাতায়। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে বৃষ্টিতে ভিজেছে কলকাতা, তার পর থেকে বৃষ্টির দেখা নেই। হাওয়া অফিস সূত্রে খবর, চলতি মাসে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলেও, এত আগে তা নিশ্চিত করে বলাও দুরূহ বলে মনে করেছেন আবহবিদরা। এ কি শুধু আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা, নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত?
গত তিরিশ বছরের গড় হিসাবে, এপ্রিল মাসে কলকাতায় বৃষ্টি হওয়ার কথা ৫৮.৯ মিলিমিটার। কিন্তু চলতি বছরে বৃষ্টির ভাঁড়ার শূন্য। কালবৈশাখী হয় ২ থেকে ৩টি। তা-ও এবছর হয়নি। বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ঝড় হয় ৭ বার মতো। চলতি বছরে তার দেখাও মেলেনি কলকাতায়।
কেন অধরা বৃষ্টি?
মূলত, উত্তর বঙ্গোপসাগরে বিপরীত ঘূর্ণাবর্তের জন্য সাগর থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু স্থলভূমিতে প্রবেশ করে। এর ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতের শুষ্ক-গরম বায়ু কলকাতা পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারে না। সেই তুলনায় পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতো পশ্চিমের জেলাগুলিতে তাপপ্রবাহ বেশি হয়। সঙ্গে গরম হাওয়া দাপিয়ে বেড়ায়। কিন্তু চলতি বছরের পরিস্থিতি অন্যান্য বছরের থেকে ভিন্ন। কারণ চলতি বছরে বিপরীত ঘূর্ণাবর্ত থাকলেও তা রয়েছে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে পশ্চিম দিক ঘেঁষে। ফলে সাগরের জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ুকে এ রাজ্যে প্রবেশ করতে অনেক বেশি পথ পেরোতে হচ্ছে। বলা ভাল, যে বায়ু আসছে তা বেশির ভাগটাই ওড়িশা, ছত্তিশগড়ের মতো স্থলভূমি পেরিয়ে আসায় সেই বায়ুতে আর বৃষ্টির হওয়ার উপযোগী জলীয় বাষ্প থাকছে না। দুর্বল এই বায়ুকে সহজেই কাবু করছে উত্তর-পশ্চিমের গরম বাতাস। ফলে চলতি বছরে উত্তর-পশ্চিমের বায়ু সহজেই রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল পেরিয়ে আরও ভিতরে আসার সুযোগ পাচ্ছে। এতে গরম হাওয়া এবং তাপপ্রবাহের অবস্থা তৈরি হচ্ছে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে।
২৯ এপ্রিলের পর বিপরীত ঘূর্ণাবর্তের অবস্থান পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সময় দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ুর পরিবর্তে দক্ষিণ-পূর্ব বায়ু প্রবাহিত হলে এ রাজ্যে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু প্রবেশ করতে পারে এবং কলকাতায় বৃষ্টির অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে ২ মে নাগাদ। তবে আবহবিদরা এ কথাও বলছেন যে, বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির ক্ষেত্রে এত আগে থেকে এলাকা ভিত্তিক পূর্বাভাস দেওয়া সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে এ-ও নিশ্চিত যে, আগামী দুই-তিন দিন শুষ্ক এবং অস্বস্তিকর আবহাওয়া থেকে নিস্তার নেই।
আবহবিদদের মতে, স্থানীয় কিছু পরিবর্তন যেমন গত বছরে তাৎক্ষণিক ভাবে লক্ষ করা গিয়েছে, তেমনি তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশ্বময় জলবায়ুগত পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। তবে চলতি বছরের এই পরিবর্তন স্থায়ী হবে কি না তা গবেষণা সাপেক্ষ বলে জানান আবহবিদ সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়। সাম্প্রতিক কালে যে বিষয়গুলি লক্ষ্য করা গিয়েছে, সেগুলি হল—
১) দীর্ঘমেয়াদি শীতকাল।
২) ফেব্রুয়ারি মাসে রেকর্ড বৃষ্টি।
৩) মার্চ মাসে দু’টি ঘূর্ণাবর্তের অস্বাভাবিক জন্ম।
৪) এ ছাড়া, উত্তর-পশ্চিম ভারতে মার্চ মাস থেকে তাপপ্রবাহ শুরু হয়ে যাওয়ায় তারও প্রভাব পড়েছে।
আবহবিদদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন বাস্তব সত্য। একই সঙ্গে ‘আবহাওয়ার চরমভাবাপন্ন হওয়ার প্রবণতা’ বাড়ছে। বলা যেতে পারে, যখন বৃষ্টি হচ্ছে না তো ছিটেফোঁটাও পড়ছে না, আবার যখন বৃষ্টি হচ্ছে তো ভাসিয়ে দিচ্ছে। তবে, ‘‘কোনও এক বছরের আবহাওয়া দেখে কলকাতার জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, বলা যাবে না। এর সঙ্গে বিশ্ব জলবায়ুর সম্পর্ক দেখতে আরও কয়েক বছর আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিতে নজর রাখতে হবে। সে কাজ আমরা ইতিমধ্যেই শুরু করেছি,’’— বললেন সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়।