বৈবাহিক ধর্ষণও অপরাধ, প্রমাণ করতে লড়াই চালাচ্ছেন এই বঙ্গতনয়া
নাম করুণা নন্দী। জন্ম ভোপালে। পেশায় আইনজীবী। ২০১২ সালের দিল্লি গণধর্ষণ মামলায় ধর্ষণ-বিরোধী বিলের খসড়া তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে যিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। করুণার কাছে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের ‘লাইসেন্স’ অন্তর্ভুক্ত করা গর্হিত অপরাধ। যিনি বলতে পারেন, ‘‘যদি স্ত্রীকে বেডরুমে যৌন নিপীড়ন, চড়থাপ্পড়, শ্লীলতাহানি কিংবা হত্যা করার আইনত অনুমতি না থাকে, তা হলে আপনি তাঁকে ধর্ষণই বা করতে পারেন কোন আইনবলে?’’
ভারতে বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়ে আইনটি ব্রিটিশ আমলের। ১৮৬০ সালের ভারতীয় দণ্ডবিধি। এ নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত। ১৬৭১ থেকে ১৬৭৬ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের প্রধান বিচারপতি ছিলেন ম্যাথু হেল। এই বিষয়ে তাঁর আইনি যুক্তি ছিল, যে বিয়ের সম্মতির মাধ্যমেই যৌনতায় সম্মতি বোঝায়। যা এক বার দেওয়া হলে আর প্রত্যাহার করা যায় না। সেই আইন ভারতে বলবৎ থাকলেও ব্রিটেন এবং অন্যান্য দেশে অনেক আগেই এই আইন বাতিল হয়েছে। আইনজীবী করুণার লড়াই এর বিরুদ্ধে।
করুণার বাবা কর্মসূত্রে ছিলেন হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে। কিন্তু নিজের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তাঁকে ভাবাত। বিদেশের চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে যোগ দিয়েছিলে দিল্লি এমসে। আর মা? করুণার এক তুতো ভাই সেরিব্রাল পলসি নিয়ে জন্মানোর পর, তাঁকে এমনই ধাক্কা দেয় যে উত্তর ভারত স্প্যাসটিক সোসাইটি তৈরি করেন। বরাবরই ডাকাবুকো স্বভাবের করুণা।
বাঙালি পরিবারে জন্ম। পড়াশোনায় ছোট থেকেই চৌখস করুণা। ভোপালের সর্দার পটেল বিদ্যালয়ের পর দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ। অর্থনীতিতে স্নাতক হওয়ার পর ভাবলেন সাংবাদিক হবেন। করলেনও কিছু দিন সাংবাদিকতা। কিন্তু এই পেশায় থাকতেই থাকতেই নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা তাঁকে টেনে নিয়ে গেল আইনের দরবারে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাশ করে এলএলএম করলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিছু দিন রাষ্ট্রপুঞ্জে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন তিনি। ২০১৬ সালে করুণার আইনজীবী হিসেবে প্রথম নাম ছড়াতে শুরু করল জিজা ঘোষ বনাম স্পাইসজেট এয়ারলাইনস মামলায়। সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত জিজাকে কলকাতা থেকে গোয়া যাওয়ার বিমানে উঠতে বাধা দেন বিমানের কর্মীরা। তিনি অভিযোগ করেন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এক জন মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন কর্তৃপক্ষ। মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে। জিজার হয়ে মামলা লড়েছিলেন আইনজীবী করুণা নন্দী। এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষকে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছিল শীর্ষ আদালত।
বাবা-মায়ের শিক্ষা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। দুর্বলের পাশে দাঁড়াতে হবে। করুণা একা লড়ছেন সবার জন্য। ২০১২ সালের দিল্লি ধর্ষণ-কাণ্ডে ধর্ষণবিরোধী বিলের খসড়া তৈরিতে বিশেষ অবদান তাঁর। তার পর বৈবাহিক ধর্ষণ, গণধর্ষণ, একাধিক মামলা লড়েছেন। আইনজীবী করুণা মনে করেন ধর্ষণ নামক ‘রোগের’ শিকড় গভীরে। কিন্তু সমাজকে তা পেরিয়ে আসতেই হবে। একাধিক ধর্ষিতার হয়ে মামলা লড়া আইনজীবী করুণাকে প্রথম নাড়া দিয়েছিল ২০১২ সালের সেই নির্ভয়া ধর্ষণকাণ্ড। তাঁর কথায়, ‘‘আমার সেই প্রথম মনে হয়েছিল, ধর্ষণ শুধু ওই ধর্ষিতার সমস্যা নয়। এটা আমাদের সবার জন্য বড় সমস্যা।’’
লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ দেশের অন্যতম প্রধান মুখ এখন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী করুণা। বর্তমানে তিনি যে লড়াই চালাচ্ছেন, তা নিয়ে বহু তর্কবিতর্ক শোনা যায়। করুণা লড়ছেন বিবাহোত্তর ধর্ষণকে আইনের চোখে অপরাধ বলে চিহ্নিত করার লড়াই। এ নিয়ে ২০১৫ সালে দিল্লি হাই কোর্টে প্রথম লিখিত হলফনামা দাখিল করেন। পরে আরও বেশ কিছু মামলা হয়েছে। ২০১৭ সালে ‘অল ইন্ডিয়া ডেমোক্র্যাটিক উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন’-এর হয়ে আইনি লড়াই করেছেন আইনজীবী করুণা।
বৈবাহিক ধর্ষণকে আইনি অপরাধে সংযুক্ত করা যায় কি না এ নিয়ে একাধিক মামলা শুনেছে আদালত। কিন্তু এমন অনেক মামলা চলছে বছরের পর বছর। আইনজীবী করুণা যাঁদের হয়ে লড়ছেন, তাঁদের ন্যায্য বিচার পাইয়ে দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য। আইনজীবী চান এর শেষ দেখে ছাড়তে। আসলে আইনজীবী করুণার নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে স্কুলে এক সহপাঠীর কাছ থেকে ধর্ষণের হুমকি পেয়েছিলেন তিনি। মাকে গিয়ে সব খুলে বলেছিলেন। তিনি ছুটে গিয়েছিলেন স্কুলে। কিন্তু প্রধান শিক্ষক তাতে আমলই দেননি। জানান এতে উদ্বেগের কোনও কারণই নেই। আইনজীবী জানান, ওই মুহূর্তই তাঁকে বুঝিয়েছিল সমস্যা কতটা গভীরের।
সম্প্রতি ভারতীয় মহিলাদের কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন আইনজীবী। চিঠির এক জায়গার বয়ান, ‘আমি লিখছি যাতে তোমরা তোমাদের ক্ষমতার কথা জানতে পার। অবশ্যই রাষ্ট্রকে তোমাদের মৌলিক অধিকার প্রয়োগের অধিকার দিতে হবে। কিন্তু নিজের অবস্থার উন্নতির দায় তোমাদের নিজেরও।’
গত ডিসেম্বরে, সরকার মহিলাদের বিয়ের বৈধ বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ বছর করেছে। যা নিয়ে নারীবাদীরা যুক্তি দিয়েছেন, এতে ফল হতে পারে উল্টো। যুবতীদের ব্যক্তিগত জীবনে তাঁদের বাবা-মায়ের হস্তক্ষেপ আরও বাড়তে পারে। একটি সমীক্ষা বলছে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ন’জন ভারতীয় (যার মধ্যে রয়েছেন মহিলারাও) এই ধারণা পোষণ করেন যে, একজন স্ত্রীকে সর্বদা তার স্বামীর বাধ্য হতে হবে।
অন্য দিকে, আইনজীবী করুণার করা মামলার বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে টুইটারে শুরু হয়েছিল হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড। তাঁরা বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ গণ্য করার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন এই বলে যে, এর ফলে বিয়ে নামের প্রতিষ্ঠানই নষ্ট হতে পারে। স্ত্রীদের কাছে স্বামীদের হয়রানি করার একটি সহজ হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে এই আইন। ‘সেভ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন’ নামে পুরুষদের-অধিকার গোষ্ঠী আবার এক ধাপ এগিয়ে পুরুষদের সম্পূর্ণ ভাবে বিয়ে বর্জন করতে উৎসাহিত করেছে। তাদের যুক্তি বৈবাহিক-ধর্ষণ আইনের অপব্যবহার হবেই। এবং মিথ্যা দোষী সাব্যস্ত হতে পারে কোনও পুরুষ। তাই বিয়ে এড়িয়ে যাওয়ায় ভাল।
আইনজীবী করুণা অবশ্য হাল ছাড়ছেন না। তিনি লড়ছেন। এ নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক কী? ২০১৭ সালে একটি মামলায় সরকার বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ করার বিরুদ্ধে যুক্তি দেয়। তাতে বলা হয় এটি বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানকে অস্থিতিশীল করতে পারে। স্বামীদের হয়রানির সহজ হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। আদালতও সেই যুক্তি গ্রহণ করেছে। তবে আইনজীবী করুণা ও অন্যান্যদের মামলার প্রেক্ষিতে বিচার বিভাগীয় বেঞ্চ ফের এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চেয়েছে। ‘‘মা আকাশ দেখতে ভালবাসত। আমার মনে হয়, মায়ের ওই শখই আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে আমি কে।’’ বলেন ‘অর্ধেক আকাশ’ আইনজীবী করুণা নন্দী।