আতঙ্কের নাম অ্যাসিড পোকা, উত্তরবঙ্গে শতাধিক পড়ুয়া আক্রান্ত
বাংলার নতুন ত্রাস অ্যাসিড পোকা। পোশাকি নাম নাইরোবি ফ্লাই। এর আক্রমণে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী এবং গবেষক অসুস্থ। নাইরোবি মাছি আদপে রোভ বিটলসের একটি প্রজাতি। পূর্ব আফ্রিকার এই পোকা বাংলা ও সিকিমে হানা দিয়েছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সিকিমের মণিপাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি শতাধিক পড়ুয়াও আক্রান্ত হয়েছেন। নাইরোবি মাছি সৃষ্ট সংক্রমণ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
নাইরোবি ফ্লাইয়ের আক্রমণে অসুস্থ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা প্রায় প্রত্যেকেই বিশ্ববিদ্যালের হস্টেলে থাকেন। প্রতিদিনই আক্রমণের ঘটনা বাড়ছে। আগামী ১২ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরস্তরের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। ফলে মাছির আক্রমণের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
পড়ুয়ারা জানাচ্ছেন, বিগত দুই সপ্তাহ যাবৎ নাইরোবি ফ্লাইয়ের আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। সন্ধ্যার পরে আক্রমণের দাপট বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের আবাসিক এক পড়ুয়া অনুকুল বর্মনের কথায়, সন্ধ্যা হতেই ক্যাম্পাসজুড়ে আতঙ্ক শুরু হচ্ছে। পোকাগুলি শরীরে বসা মাত্রই, সেই অংশ পুড়ে গিয়ে ফোসকা পরে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে চলছে অসহ্য যন্ত্রণা। আরেক পড়ুয়া সৌরভ রায় জানাচ্ছেন, মাছির আক্রমণের ভয়ে তাদের পড়াশোনা হচ্ছে না। তাদের ছাত্রাবাসে কয়েকজন বাদেই, প্রায় সকলেই মাছির আক্রমণে অসুস্থ। প্রত্যেকেরই জ্বর ও ব্যথা রয়েছে। মাছির আতঙ্কে অনেকেই ছাত্রাবাস ছেড়ে দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে দিশেহারা ছাত্র-ছাত্রীরা। ক্যাম্পাসের চিকিৎসা পরিষেবাও ঠিকমতো মিলছে না বলে অভিযোগ। কার্যত বাধ্য হয়ে অনেকেই বাইরে গিয়ে ডাক্তার দেখাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ডিন সুভাষচন্দ্র রায়ের মতে, তারা পরিস্থিতির উপর নজরদারি চালাচ্ছেন। কয়েকদিন আগেই ক্যাম্পাস স্যানিটাইজ করা হয়েছে। আবাসিকদের তারা সাবধানে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে তারা মেডিকেল কলেজের সহযোগিতা নেবেন বলেও জানিয়েছেন সুভাষ বাবু। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অবহেলা না করলে পোকা কামড়ালে অবিলম্বে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
রোভ বিটেল প্রজাতির পোকাটি চলতি কথায় অ্যাসিড পোকা নামেই পরিচিত। নাইরোবি ফ্লাইকে কিংস অফ পেন বা ব্যথার রাজা বলা হয়। মাছিটি দৈর্ঘ্যে ৭-১০ মিলিমিটার লম্বা হয়। দেখতে কালো ও কমলা রঙের এই পোকা এখন বাংলার আতঙ্কের আরেক নাম৷ মাছিটি দংশন করতে অর্থাৎ হুল ফোটাটে পারে।
নাইরোবি মাছি কীটপতঙ্গ খায় এবং ফসল নষ্ট করে। রোড বিটল নামে পরিচিত এই মাছি বিটল পরিবারের সদস্য। এদের গায়ে চাপ লাগলেই বিষাক্ত ক্ষতিকারক পদার্থ নির্গত হয়। নাইরোবি মাছিতে পিডেরিন নামক ক্ষতিকারক পদার্থ থাকায়, নাইরোবি ফ্লাইকে “ড্রাগন বাগ” বলা হয়। বিটলগুলি দংশনে অক্ষম, তবে তাদের হেমোলিম্ফে পিডেরিন থাকে, এই শক্তিশালী টক্সিন ফোসকা এবং পেডারাস ডার্মাটাইটিস সৃষ্টি করে। নাইরোবি মাছির দেহ থেকে পিডেরিন নামক একপ্রকার বিষাক্ত ও ক্ষতিকর পদার্থ নিঃসৃত হয়, যা মানুষের ত্বকের ক্ষতি করে। অ্যাসিড জাতীয় ওই পদার্থের সংস্পর্শ আসা মাত্রই ত্বক পুড়ে যায়। ত্বকে রীতিমতো ফোসকা পরে যায়। পোকার কামড়ানোর ফলে শরীরের যে অংশে ক্ষত সৃষ্টি হয়, সেই অংশটি শরীরের অন্য কোন অংশের সংস্পর্শে আসলে সেখানেও ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে। অ্যাসিড মাছির আক্রমণে সৃষ্ট ক্ষতস্থানে ও তার আশেপাশ জ্বালাপোড়া, ব্যাথা হয়। সেই সঙ্গে বমিভাব, মাথাব্যাথা, জ্বর থাকছে। মাছিটি যদি কারও চোখের সংস্পর্শে আসে, সেক্ষেত্রে ওই আক্রান্ত ব্যক্তি দৃষ্টিশক্তিও হারাতে পারেন।
মূলত বর্ষাকালেই এদের উপদ্রব বাড়ে। জলাধার, কৃষিক্ষেত্র, ধানখেত, জঞ্জাল জমে থাকা এলাকা, ডাস্টবিন, জঙ্গলে এদের বেশি দেখা যায়। ঘরের আলোর দ্বারা মাছিগুলো আকৃষ্ট হয়। সেই কারণেই জনবহুল অঞ্চলে সন্ধ্যার পরই এদের তাণ্ডব চলে।
শোনা যাচ্ছে, কীটনাশক ব্যবহার করেও এদের মারা যায় না। আগুনে পুড়িয়া বা অক্সিজেনের অভাবে নাইরোবি মাছিকে মেরে ফেলা যায়। আক্রমণ প্রতিহত করতে, বাড়ির আশেপাশে জঞ্জাল মুক্ত করে রাখা, জলাধার পরিষ্কার পরিচ্ছন রাখা, সন্ধ্যার আগেই বাড়ির দরজা, জানালা বন্ধ করে দেওয়া, ঘরে হলুদ আলো ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিষেশজ্ঞরা। পাশাপাশি আক্রমণ রুখতে ঘরের আলো নিভিয়ে, বাইরে আলো জ্বালিয়ে রাখার নিদান দিচ্ছেন বিষেশজ্ঞদের একাংশ। মশারি টাঙিয়ে এবং আলো নিভিয়ে ঘুমানোর নিদান দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিছানার চাদর, বালিশ, তোশক ইত্যাদি পরিষ্কার রাখার বিষয়ে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্ধকারে মোবাইল ব্যবহারেও নিষেধ করা হচ্ছে।
রবিবার ৩ জুলাই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবাসের আবাসিকদের ওষুধপত্র দেওয়া হয়েছে। তারা আক্রমণ ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার আর্জি জানিয়েছেন। আবাসিকদের সবরকমভাবে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
জানা গিয়েছে, মাছি গায়ে বসা মাত্র স্পর্শ করলেই, মাছিটি ক্ষতিকারক অ্যাসিড জাতীয় পদার্থ নির্গত করে। তাই এই মাছগুলোকে স্পর্শ করা উচিত নয়। কেবল আলতো করে উড়িয়ে দেওয়া উচিত। মাছিটি যদি হাতে বসে, তবে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার পরে, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।