কলাবউ স্নান দিয়েই সপ্তমীর ভোর শুরু, তিনি কি সত্যিই গণেশের স্ত্রী?
আজ সপ্তমী, (Maha Saptami) আজকের দিনে কলা বউ স্নানের মধ্যে দিয়ে দুর্গাপুজোর শুরু হয়। গঙ্গার ঘাটে ঘাটে কলা বউ স্নানকে ঘিরে তুঙ্গে ব্যস্ততা। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী কলা বউ আদপে দুর্গার পরিবারের একজন। দুর্গাপুজোয় লাল শাড়িতে বধূ বেশে দুর্গার পরিবারের সাথেই কলা বউ থাকেন। মনে করা হয়, গণেশের বউ কলা বউ, কিন্তু আদপে তিনি গণেশের বউ নন।
পৌরাণিক ইতিহাস বলে, গণেশের দুই স্ত্রী। তারা হলেন রিদ্ধি ও সিদ্ধি। দেবতাদের স্ত্রীরা সবসময় দেবতাদের বাম দিকে অবস্থান করতেন। কিন্তু কলা বউ গণেশের ডান দিকে অবস্থান করেন। মহাসপ্তমীর দিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় কলাবউ স্নান। স্নানের পর তাকে মা দুর্গার পাশে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তারপর শুরু হয় মূল পুজো। কলাবউ আসলে দেবী দুর্গার অন্য একটি রূপ, সেই কারণেই কলাগাছকে মন্ডপের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কলাবউ আসলে নবপত্রিকা যা দেবী দুর্গার বৃক্ষ রূপ।
আবার মা দুর্গার নয় রূপের অন্যতম এক প্রতীক হল নবপত্রিকা, অর্থাৎ গাছের নয়টি পাতা। এই নয়টি গাছ মায়ের নয় রূপকে চিহ্নিত করে। এই নয়টি উদ্ভিদ হল- রম্ভা অর্থাৎ কলাগাছ, কচু গাছ, হরিদ্রা অথবা হলুদ, জয়ন্তী, বিল্ব অর্থাৎ বেল, দাড়িম্ব অর্থাৎ ডালিম গাছ, অশোক গাছ, মান গাছ, ধান গাছ। এই নয় গাছ দেবীর নয় রূপকে বোঝায়, সেগুলো হল-ব্রহ্মাণী, কালিকা, উমা, কার্তিকী, শিবা, রক্তদন্তিকা, শোকরহিতা, চামুন্ডা ও লক্ষ্মী। তবে এই নয় দেবীর মধ্যে একমাত্র দেবী চামুণ্ডা ছাড়া অন্য কোনও দেবীর পুজো হয়না।
কলাগাছ দেবী ব্রহ্মাণীর প্রতীক স্বরূপ, কচু গাছ দেবী কালিকার প্রতীক, দেবী উমার প্রতীক হল হরিদ্রা গাছ, দেবী কার্তিকীর প্রতীক জয়ন্তী গাছ, দেবী শিবার প্রতীক বিল্ব গাছ এবং দেবী রক্তদন্তিকার প্রতীক গাছ হল দাড়িম্ব বৃক্ষ। অন্যদিকে, দেবী শোকরহিতার প্রতীকস্বরূপ গাছ হল অশোক গাছ, মান গাছে অধিষ্ঠান করেন দেবী চামুণ্ডা আর ধান গাছে দেবী লক্ষ্মী থাকেন। সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি পাতাসহ গাছ একসঙ্গে দুটি বেলের সঙ্গে অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে মাথায় সিঁদুর পরিয়ে ঘোমটা দিয়ে নতুন বউয়ের আকারে সাজানো হয়। এরপর সেটা রাখা হয় গণেশ ঠাকুরের ডানদিকে। নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়। এই নয় দেবী একত্রে “নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা” নামে নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ মন্ত্রে পূজিতা হন। নবপত্রিকা দুর্গারই এক মূর্তি, ধরিত্রীমাতা বা শস্যবধূর প্রতীক। পুরাণ মতে, কৃষি প্রধান বঙ্গসমাজে শষ্যদায়িনী ধরনীমাতার আরাধনাই হল নবপত্রিকার পুজো। যা বাঙালির কাছে ‘কলাবউ’ হিসেবে পরিচিত।
সপ্তমীর সকালে এই নবপত্রিকার স্নান উল্লেখযোগ্য একটি আচার। গঙ্গা, পুকুর বা কোনও জলাশয়ে নবপত্রিকা স্নান (Kola Bou Snan) করানো হয়। কলা বউ বা নবপত্রিকা স্নানের জন্যে তেল-হলুদ, অষ্টকলস, পঞ্চরত্নের জল, পঞ্চ অমৃত, পঞ্চ শস্য, পঞ্চ গব্য, পঞ্চ কষায়, বৃষ্টির জল, ডাবের জল, শিশির, সমুদ্রের জল, তীর্থের জল, আখের রস, বরাহদন্ত মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা, সর্ব ঔষধি, মহা ঔষধি, চতুষ্পদ মৃত্তিকা, পদ্মরেণু, চন্দন। এই সমস্ত কিছু দিয়ে কলা বউকে স্নান করিয়ে অধিষ্ঠিত করা হয় গণেশের পাশে। শাস্ত্রে রয়েছে, কলা বউকে দেবীর ডান পাশে রাখতে হয়। দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল বনেদি বাড়ি থেকে, তখন সবই ছিল একচালার ঠাকুর। তাই কলা বউকে রাখা হত দেবীর ডানপাশে, একেবারে গনেশের পাশে। পরে অবশ্য একচালার ঠাকুরের পরিবর্তে আলাদা আলাদা করে ঠাকুর তৈরির রীতির প্রচলিত হয়েছে। কিন্তু কলা বউ বা নবপত্রিকা গণেশের পাশেই রয়ে গেল। কালে কালে লোকমুখে তিনিই আমাদের কাছে গণেশের স্ত্রী হিসেবে পরিচিতি পেলেন।