লক্ষ্মীর পদ চিহ্ন কি নিছকই আলপনা নাকি স্বয়ং লক্ষ্মী দেবীর প্রতীক
সৌভিক রাজ
বঙ্গে বারো মাসে তেরো পার্বণ, এই হাজারও পালা-পার্বণের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো। যদিও লক্ষ্মী পুজো চলে সারা বছরজুড়ে, তবে ব্যাপ্তির নিরিখে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোই হল শ্রেষ্ঠতম। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল আলপনা। বিয়ে থেকে শুরু করে পুজো, যেকোনও আনন্দানুষ্ঠানে আলপনা উৎসবের অঙ্গ হয়ে ওঠে। আলপনার রকমফেরও রয়েছে অসংখ্য। যেমন লক্ষ্মী পুজোতেই প্যাঁচা, ধানের ছড়া, শঙ্খ, পদ্ম, পদচিহ্ন ইত্যাদি আলপনা আঁকা হয়। পূর্ববঙ্গীয়দের মধ্যে আবার লক্ষ্মী পুজোর আলপনায় মাছেরও দেখা মেলে। তারা আবার লক্ষ্মীদেবীর ভোগেও মাছ নিবেদন করেন। অজস্র রীতিতে লক্ষ্মী পুজো হলেও লক্ষ্মীর পদযুগলের আলপনা দেওয়ার রীতিটি সর্বত্র দেখা যায়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার ব্রতকথায় আলপনা প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, সন্ধ্যায় আয়োজিত পুজো উপলক্ষ্যে সকাল থেকে মেয়েরা ঘরগুলি আলপনায় সাজিয়ে তোলে। লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, লক্ষ্মীপেঁচা এবং ধানছড়া এঁকে ঘর সাজায়। গোলাঘরের মধ্যবর্তী খুঁটির গায়ে লক্ষ্মীনারায়ণ, প্যাঁচা, পদ্ম, ধানছড়া, কলমিলতা, দোপাটিলতা, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকা হয়। রচন পাত্রের গায়ে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন ও ধানছড়া আঁকা হয় এবং তার উপরে লক্ষ্মীর সরা থাকে। সরার পিঠও আলপনায় রাঙানো হয়। বাড়ির মেয়ে-বউদের আঁকা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন কি নিছক আলপনা? নাকি এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও কারণ?
আলপনার মধ্যে একটা নান্দনিক শিল্প বোধ কাজ করে। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে মহিলারা আলপনা আঁকেন। কিন্তু প্রথা মাফিক কোজাগরী পুজোয় লক্ষ্মীর পা আঁকার কিন্তু চলে আসছে দীর্ঘকাল। আলপনা শব্দের বুৎপত্তি নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে, কেউ কেউ একে তদ্ভব শব্দ বলেছেন, আবার একদল বলেছেন তৎসম শব্দ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, আদীপন থেকে আলীপন হয়ে আলপনের জন্ম। তবে এককথায় বলতে গেলে বলতে হয়, আলপনা হল কামনার প্রতিচ্ছবি। ইহজাগতিক বাসনা, যেমন সম্পদ সমৃদ্ধি প্রার্থনা, সুস্থ নীরোগ জীবন কামনা, সাংসারিক শ্রীবৃদ্ধির আকাঙ্খা ইত্যাদি নিহিত থাকে আলপনায়।
সেঁজুতি ব্রতের ছড়ায় আলপনায় নিয়ে ব্রতীর নিজস্ব আকাঙ্খা ফুটে ওঠে, ওই ব্রতের ছড়ায় বলা হচ্ছে-
আমি আঁকি পিটুলির গোলা,
আমার হোক ধানের গোলা।
আমি আঁকি পিটুলির গোলা,
আমার হোক সোনার বালা।
এখানে ধানের গোলা, সোনার বালা কামনা করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, পিটুলি হল চালের গুঁড়ো। তা দিয়েই আলপনা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। এবার আসি লক্ষ্মীর পদ যুগলের বিষয়।
লক্ষ্মী ব্রতে বলা হচ্ছে-
আঁকিলাম পদ দুটি
তাই মাগো নিই লুট
দিবারাত পা দুটি ধরি,
বন্দনা করি।
আঁকি মাগো আলপনা,
এই পূজা এই বন্দনা।
ক্ষম দোষ,
দাও সান্তনা।
তুমি জায়া তুমি ভর্তা তুমি স্বর্গবাসী,
তোমায় জানি মা আমি তোমায় ভালবাসি।
তুমি মাগো এসো হেথা,
ঘুচাও মোদের মনোব্যথা,
সংসার করো মা গো শুভ।
আমি কিছু জানি না মা
এমুখে কি কব।
আমি যে মা অধম দাসী,
তুমি মা মহিয়সী।
ভয়াতুরা আমি যে গো,
দাও গো সান্তনা।
আঁকিলাম আলপনা,
দূরে ফেলি আর্বজনা
শুভ্র শুদ্ধ মন নিয়ে করি তব আরাধনা,
তোমার আশীষ মা যে,
সুখে থাকে জনগণ!
এক কথায় মায়ের কাছে কৃপা-করুনা প্রার্থনা করা হচ্ছে, মা যেন ব্রতীর ঘরে আসেন। পা দুটির কাছেই যেন মা লক্ষ্মী হিসেবে আর্তি জানানো হচ্ছে। লক্ষ্মী পুজোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানেও সেই একই প্রার্থনা পাওয়া যায়, এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে। কোজাগরী শব্দের অর্থেও একই জিনিস, যে জেগে থাকবেন মা তার বাড়ি যাবেন। এর থেকে আজকের ধারণা জন্ম, ওই পদ চিহ্নের আলপনার অর্থ হল মা ওই পথ ধরেই ব্রতীর বাড়িতে আসেন। তাই দরজার গোড়া থেকে পায়ের ছাপ আঁকা শুরু হয়।
সত্যিই কি তাই?
রাতে এসে সম্পদ দিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে কেমন যেন স্যান্টা আর লক্ষ্মী একাকার হয়ে গিয়েছেন। সে অন্য কথা, প্রসঙ্গে ফিরি।নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালির ইতিহাস গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে লিখে গিয়েছেন, “আমাদের লক্ষ্মীর পৃথক মূর্তিপূজা খুব সুপ্রচলিত নয়। লক্ষ্মীর পূজা ঘট লক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কত ঘটের পূজা। বাঙালীরা কখনও কলাগাছ কখনও মাটির চিত্রাঙ্কিত সরা, মাটির পট কিংবা ধানের ছড়ায় দেবীকে কল্পনা করে পুজো করেন।” বলাবাহুল্য যেগুলিকে লক্ষ্মী হিসেবে করে পুজো করা হত, মূর্তির প্রচলন হতেই সেগুলি আলপনার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। সেগুলি সবই সমৃদ্ধি-সম্পদের প্রতীক। ধানের ছড়া, কলা গাছ কৃষিজ সমৃদ্ধির প্রতীক, কোথাও কোথাও আজও কোজাগরী পূর্ণিমায় নৌকা পুজো করা হয়, সেটিও বাণিজ্যের প্রতীক। একদা জলপথেই বাণিজ্য হত। পরবর্তীতে এগুলোই আলপনায় ঢুকে গিয়েছে এবং কালের নিয়মে আরও অনেক কিছু জুড়েওছে।
তেমনই লক্ষ্মীর পদ যুগল একদা লক্ষ্মী রূপেই পূজিত হত। একদল গবেষকদের মতে, লক্ষ্মী একদা লৌকিক দেবী ছিলেন। তিনি ছিলেন আদিমাতা ও পৃথ্বীমাতার রূপভেদ। জৈনসাহিত্যে লক্ষ্মীকে গন্ধর্ব কিন্নর প্রমুখ ব্যন্তর দেবতা বা মধ্যবর্তী দেবতাদের শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দ্বাদশ শতকের আগে অবধি কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী পুজোর চল ছিল না। বাংলার অনেক লৌকিক দেব-দেবীকেই সংকেত বা অন্য কোনও প্রতীকের মধ্যে আরাধনা করা হয়। যেমন, সিনি দেবী, মসান ঠাকুর, ক্ষেত্রপাল প্রমুখ লৌকিক দেবদেবীরা তো কোনও না কোনও প্রতীকেরা দ্বারাই পূজিত হন। ঠিক তেমন লক্ষ্মীও পূজিত হতেন পদ চিহ্নের মাধ্যমে। লক্ষ্মীর পদ চিহ্ন কিন্তু আজ থেকে একশো বছর আগে সংকেত হিসেবেও ব্যবহৃত হত। বিয়ের নিমন্ত্রণের চিঠিতে লাল রঙে লক্ষ্মীর পদ যুগল আঁকা হত। তবে পদ চিহ্ন পুজোর রেওয়াজ দীর্ঘদিনের, তা আজও রয়েছে, নবদ্বীপে নিমাইয়ের পদ চিহ্নের পুজো করা হয়। দক্ষিনেশ্বর-কালীঘাট ইত্যাদি জায়গায় কালী পায়ের অবয়ব বিক্রি হতে দেখা যায়। ভক্তরা তা কিনে নিয়ে গিয়ে পুজো করেন। মৃত মানুষের পায়ের ছাপ রেখে দেওয়াও আমাদের এক প্রাচীন রীতি। আজও পদ চিহ্ন দেখেই জঙ্গলের প্রাণীদের শুমারি করা হয়। প্রাচীন যুগে হিংস্র জন্তুর থেকে নিরাপদে থাকার ইঙ্গিত বহন করত পদ চিহ্নের উপস্থিতি। অর্থাৎ পদ চিহ্ন হল উপস্থিতি বা অস্তিত্ববাদের ধারক-বাহক।
কালে কালে লক্ষ্মীর পদ চিহ্নের বদলে অন্যান্য প্রতীকে তাঁর আরাধনা শুরু হল, মূর্তি এল। মূর্তির বাড়বাড়ন্ত শুরু হল আর পুজোর মাধ্যম বা আধার পদ চিহ্ন গিয়ে ঠেকল আলপনায়। আজও যে আসনে লক্ষ্মী মূর্তি স্থাপন করে পুজো করা হয় তার নীচেও পদ চিহ্ন আঁকা হয়। পিঁড়িতেও লক্ষ্মীর পা আঁকা হয়। সংকল্পের ঘটের নীচে অনেকে আঁকেন। এখানেই স্পষ্ট হয় মূর্তি এসে প্রতীকের জায়গার দখল নিল। হেঁটে এসে লক্ষ্মী প্রবেশ করার তত্ত্ব একেবারেই নবীন, গত দেড় শতকের মধ্যে এই তত্ত্বের জন্ম হয়েছে। জোড়া পায়ে তো কেউ হাঁটতে পারে না, তাই হেঁটে আসার ভঙ্গিমার সঙ্গে আলপনার আঁকা বাস্তবিক অর্থে মেলে না। অন্ততঃ দ্বিপদ গমনের নিয়মে তা মেলে না। অন্যভাবে হলেও, অদ্যাবধি লক্ষ্মী পুজোর সঙ্গে মিশে রয়েছে লক্ষ্মীর পদ যুগল। পিটুলি-খড়িমাটির আমল আজ অতীত। স্টিকারেই পা-ই এখন কোজাগরী পূর্ণিমার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এক্ষেত্রেও পদ যুগল কিন্তু অক্ষত।