হেমন্তের হৈমন্তীকাই কৃষ্ণচন্দ্রের জগদ্ধাত্রী
উমা ফিরে গিয়েছেন আশ্বিনে, শ্যামাও ফিরে গিয়েছে, এবার হেমন্তে হৈমন্তীকার আরাধনার পালা। দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনার মধ্যে দিয়ে শেষ হবে বাঙালির উৎসবের মরশুম। জগদ্ধাত্রী অর্থাৎ জগৎকে ধারণ করেছেন যিনি। মায়ের আরেক নাম উমা হৈমবতী।জগদ্ধাত্রী পুজো, কৃষ্ণনগর আর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়; যেন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে এই বাংলায়। ঐতিহাসিকদের মতে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন। জগদ্ধাত্রী দুর্গারই ভিন্ন এক রূপ, দেবীও সিংহবাহিনী। গবেষকেরা মনে করেন, পাল ও সেন যুগেও বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন ছিল। তদানিন্তন সময়ের বিভিন্ন তন্ত্র গ্রন্থে জগদ্ধাত্রী পুজোর উল্লেখ রয়েছে। যেমন, ‘মায়াতন্ত্রে’ রয়েছে – ‘প্রপূজয়েজগদ্ধাত্রীং কার্তিকে শুক্লপক্ষকে দিনোদয়ে চ মধ্যাহ্নে সায়াহ্নে নবমেহহন।’ অর্থাৎ কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দিনের শুরুতে মধ্যাহ্নে এবং সায়াহ্নে জগদ্ধাত্রী পুজো করা যায়।
প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী, আধুনিক যুগে কৃষ্ণচন্দ্রই এই পুজোর প্রবর্তক। সুবে বাংলায় তখন নবাব আলিবর্দী খানের শাসন চলছে। বকেয়া রাজস্ব দিতে না পারায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দি করেছিলেন আলিবর্দী। সময়টা ছিল ১৭৫৪ সাল। কেউ কেউ বলেন, এর পিছনে ছিল সিরাজের ইন্ধন। ৯ লক্ষ টাকা দাবি করা হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে। বন্ধু রাজা, জমিদার ও সাহেবদের সাহায্যে ওই টাকা দিয়ে মুক্ত হন কৃষ্ণচন্দ্র।
কৃষ্ণচন্দ্র যখন কারাগার থেকে মুক্ত হলেন, তখন দুর্গোৎসব শেষ হয়ে গিয়েছে। দশমীর দিন, নদীপথে ফিরছেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ঢাক বাজছে, উলুধ্বনি চলেছে, সেবার পুজোয় উপস্থিত থাকতে না পারায় বিষণ্ণচিত্তে মহারাজ নৌকার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সেসময় রাজ পরিবারে দুর্গা পুজো হত, আরাধ্যা দেবী ছিলেন রাজরাজেশ্বরী। তার পায়ে অঞ্জলি দিতে না পারায় দুঃখে কাতর ছিলেন রাজা। জনশ্রুতি অনুযায়ী, নৌকার মধ্যেই কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, এক রক্তবর্ণা চতুর্ভূজা কুমারী দেবী তাঁকে বলছেন আগামী কার্তিক মাসের শুক্লানবমী তিথিতে তাঁর পুজো করতে। তবেই মিলবে দেবীর আশীর্বাদ। বাড়ি ফিরেই কৃষ্ণচন্দ্র ডেকে পাঠালেন পুরোহিতদের। সব শুনে তাঁরা নিদান দিলেন, ইনিই দেবী জগদ্ধাত্রী। তৈরি হল দেবীর মূর্তি। এই মূর্তি নিয়েও নানা গল্প প্রচলিত রয়েছে।
অন্যমতে, কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দি করেছিলেন মীরকাশিম। পলাশীর ষড়যন্ত্রে সামিল ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। তিনি ইংরেজদের মিত্র, এই সন্দেহেই ১৭৬৪ সালে মীরকাশিম মুঙ্গেরের কারাগারে বন্দি করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রকে। শোনা যায়, মীরকাশিম নাকি কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। কারাগারেই কৃষ্ণচন্দ্র এক কুমারী দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন এবং কারামুক্তির প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন। এই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি কারামুক্ত হয়েছিলেন এবং ফিরে এসে সেই স্বপ্নে দেখা দেবীর মূর্তি তৈরি করে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেছিলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক, মনে করা হয়, ১৭৫৪-তে বা মতান্তরে ১৭৬২ সালে তিনি জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে আজও মেয়েরূপে দেবী পুজো পান। এখানে মা মহামায়ার পুজো হয়, সিংহবাহিনী দেবীর বাহন সিংহের মুখ ঘোড়ার মতো। দেবীর একটি পা উঁচু, যেন সমরে যেতে দেবী প্রস্তুত। একদিনেই সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পুজো নবমী তিথিতে সম্পন্ন হয়। মাকে আমিষ নিরামিষ, দুই ভোগই দেওয়া হয়। যজ্ঞ হয়, সন্ধি পুজো চলে। আগে বলি হত, কিন্তু এখন কেবল চাল কুমড়ো বলি দেওয়া হয়। মাকে খিচুড়ি, নানা রকম ভাজা, ভাজা মিষ্টি ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়।