কলকাতা বিভাগে ফিরে যান

আকাশ প্রদীপ, বৈচিত্রের বাংলার এক লোকাচার

November 4, 2022 | 2 min read

সৌভিক রাজ

‘অসতো মা সদ্‌গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়- অন্ধকার’- তমসা ঘুচিয়ে আলোয় নিয়ে যাওয়ার আকুতি লুকিয়ে থাকা এক প্রার্থনা; এ জিনিস শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। সাধারণত কালীপুজো অর্থাৎ দীপান্বিতা অম্যবসা তিথিটি কার্তিকেই পড়ে। তিথি অনুযায়ী তার আগের দিন চোদ্দ প্রদীপ দেওয়ার নিয়ম। পুজো-পাঠের অন্যতম অঙ্গ প্রদীপ। ব্রাহ্মণ, মুনি-ঋষিদের যজ্ঞের আগুন কালক্রমে গৃহস্থ বাড়ির প্রদীপে পরিণত হয়েছে। পুজোয় অর্ঘ্যের পরেই ধূপ ও দীপ দিয়ে ঈশ্বরের আবাহন করা হয়। তুলসী তলায় প্রদীপ, ​নিত্যদিনের সন্ধ্যা প্রদীপ, কখনও ১০৮ প্রদীপ আবার কখনও পঞ্চপ্রদীপ, নিরাকার থেকে সাকার; সব আরাধনাতেই রয়ে গিয়েছে আগুন, তবে প্রদীপের মাধ্যমে। স্বভাবতই প্রদীপের জন্যে একটি দিন থাকা খুব একটা আশ্চর্যের কিছু নয়। কিন্তু প্রদীপের জন্য বাঙালির আস্ত একখানা মাসও ছিল! থুরি আজও আছে। তবে ধারেবারে কম।

আজও কার্তিক মাসের নাম শুনলে মনে পড়ে আকাশ প্রদীপের কথা। আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে…। সন্ধ্যে হলেই নিকষ আঁধারে জ্বলে উঠত বিন্দু বিন্দু আলো। আশ্বিন মাসের শেষ দিন অর্থাৎ গারসি সংক্রান্তি থেকে কার্তিক মাসের শেষ দিন পর্যন্ত, এক মাসব্যাপী প্রতিদিন মাটির প্রদীপ জ্বালানোর রীতিই আকাশ প্রদীপ। এককালে সব বাড়িতেই আকাশ প্রদীপ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। এখন কেবল গ্রামেগঞ্জে তা চোখে পড়ে।

মূলত বাড়ির কোনও উঁচু স্থানে প্রদীপ দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাঁশের খুঁটির ওপর বা অন্য কোনও গাছে প্রদীপ জ্বালানো হয়। জ্বালাতে তেল বা ঘি ব্যবহার করা হয়। বাঁশ বা কোনও দণ্ডের মাথায় অষ্টকোণযুক্ত পট্টির ভিতরে প্রদীপ রাখা হয়। প্রদীপের চারপাশে এই ঘেরা দেওয়ার কারণ আগুনের নিভে যাওয়া ঠেকানো। দামোদর অর্থাৎ ভগবান বিষ্ণু এবং মা লক্ষীর উদ্দেশ্যে কার্তিক মাসে আকাশ প্রদীপ প্রজ্জলন করা হয়। আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ -অর্থাৎ আকাশে লক্ষ্মীর সঙ্গে যে বিষ্ণু অবস্থান করছেন, তাঁর উদ্দেশ্যেই প্রদীপ দেওয়া হচ্ছে। হেমন্ত ঋতু বদলের সময়, বিকেল শেষ হয়ে যখন অন্ধকার নামে তখনই প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।
প্রদীপ দিতে দিতে বলা হয়,
“দামোদরায় নভসি তুলায়াং লোলয় সহ
প্রদীপং তে প্রযচ্ছামি নমোহনস্তায় বেধসে।”

লক্ষ্মীর সঙ্গে দামোদরের উদ্দেশ্যে প্রদীপ নিবেদন হচ্ছে, তাঁদেরকে প্রণাম।

তবে কেবল ঈশ্বর নয়। পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যেও এই মাটির প্রদীপ নিবেদন করা হয়। প্রদীপ মানুষের দেহের প্রতীক। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম অর্থাৎ পঞ্চভূত নিয়ে যেমন মানব দেহ তৈরি, ঠিক তেমন পঞ্চভূত নিয়ে প্রদীপও নির্মিত হয়। আবার মানব দেহ পঞ্চভুতেই বিলীন হয়। আকাশ প্রদীপের মাধ্যমে প্রেতলোকে থিতু হওয়া পূর্বপুরুষদের আবাহন করা হয়। মনে করা হয়, প্রদীপের আলোর রেখা অবলম্বন করে পূর্বপুরুষরা মর্তে আসেন এবং উত্তরসূরীদের আশীর্বাদ করেন।

সেই কারণে আকাশপ্রদীপ দেওয়া সময় এও বলা হয়,
“নিবেদ্য ধৰ্ম্মার হরায় ভূম্যৈ দামোদরায়াপ্যথ ধৰ্ম্মরাজে
প্রজাপতিভ্যত্বথ সৎপিতৃভ্যঃ প্রেতেভ্য এবাথ তমঃ স্থিতেভ্যঃ।‘’

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#tradition, #Festival, #Akash Pradip, #Culture, #Bengal, #traditional

আরো দেখুন