অপার মাতৃস্নেহের আধার সারদা ছিলেন স্বরূপিণী পরমাপ্রকৃতি জগজ্জননী
সৌভিক রাজ
আজ মায়ের জন্মতিথি। জঠরে ধারণ করলেই কি মা হওয়া যায়? মাতৃত্বের চিরাচরিত সংজ্ঞা ভেঙে সকলের মা হয়ে উঠেছিলেন মা সারদা। শ্রীশ্রীমা সারদা সঙ্ঘজননী মাতৃ স্বরূপিণী পরমাপ্রকৃতি। তিনি বিদেশিনী বিধর্মীকে মেয়ে বলে বুকে টেনে নিতে পারেন। হয়ে উঠতে পারেন শত সহস্র সন্তানের জননী।
তাঁর নিজের কথায়, তিনি সত্যিকারের মা, গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয়— সত্য জননী। অপার মাতৃস্নেহ, তিনি সকলেরই মা। নিজের সম্পর্কে তিনি বলতেন- আমি সতেরও মা, অসতেরও মা। আবার ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভক্তদের কাছে বলেছিলেন- ও সারদা, সাক্ষাৎ সরস্বতী!
‘যত মত তত পথ’-এর দিশারী ঠাকুরকে সাধনার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়াই ছিল মায়ের শ্রেষ্ঠ কাজ। ১৮৫৯ সালের মে মাসে, মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সঙ্গে মায়ের বিবাহ সম্পন্ন হয়। সারদা ছিলেন জীবন্ত ভগবতী। ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁকে জগজ্জননী রূপে পুজো করলেন। এর অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। সারা জীবন ঠাকুর ঈশ্বরকে মাতৃরূপে আরাধনা করেছেন। সেই মাতৃরূপিণী শক্তিকে তিনি সারদাতে আরোপিত করলেন, তারপর তাঁর পদপ্রান্তে নিজের সব সাধনা উৎসর্গ করে দিলেন। ফলহারিণী কালীপূজার পুণ্যদিনে ঠাকুর এই ষোড়শী পূজা করেছিলেন। সারদা তখন ষোড়শী নন, অষ্টাদশী।
শক্তিরূপিণী মায়ের এক নাম ষোড়শী। ষোড়শী অবশ্য রাজরাজেশ্বরী এবং ত্রিপুরসুন্দরী নামেও পরিচিত। ঠাকুরের এই ষোড়শী পুজা, নিজের স্ত্রীকে জগজ্জননী রূপে আরাধনা অধ্যাত্মজগতে এক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। চেতনানন্দ বলছেন, কোনও কোনও অবতার বিবাহ করেছেন, যেমন— রামচন্দ্র, রামকৃষ্ণ। কোনও কোনও অবতার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছেন, যেমন— বুদ্ধ, চৈতন্য। রামকৃষ্ণ স্ত্রীকে পরিত্যাগ করলেন না, তাঁকে শক্তি রূপে আরাধনা করলেন। এ এক বিরল, ব্যতিক্রমী ঘটনা। ডাকাত বা বিপথগামী মানুষ, আরও কত শত মানুষকে তিনি জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছেন। এ কারণেই তিনি বিশ্বজননী।
১৮৫৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর, বাংলা পঞ্জিকা মতে ১২৬০ সালের ৮ই পৌষ, বৃহস্পতিবারে রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামাসুন্দরী দেবীর কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন সারদামণি। তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ক্ষেমঙ্করী। মায়ের নিজের কথায়, ‘আমি হবার আগে, আমার যে মাসিমা এখানে সেদিন এসেছিলেন, তাঁর একটি মেয়ে হয়। মাসিমা তার নাম রেখেছিলেন সারদা। সেই মেয়ে মারা যাবার পরেই আমি হই। মাসিমা আমার মাকে বলেন, দিদি, তোর মেয়ের নামটি বদলে সারদা রাখ; তাহলে আমি মনে করব আমার সারদাই তোর কাছে এসেছে এবং আমি ওকে দেখে ভুলে থাকব। তাইতে আমার মা আমার নাম সারদা রাখলেন।’
কেমন করে মায়ের জন্মদিবস পালন করা হত? ব্যক্তিগতভাবে জন্মতিথিতে বিশেষ আয়োজন করা তেমন পছন্দ ছিল না মায়ের। জানা যায়, ১৯০৭ সালে জয়রামবাটিতে জন্মদিনে কী হবে জানতে চাইলে মা বলেছিলেন- ‘আমি একখানা নতুন কাপড় পরব, ঠাকুরকে একটু মিষ্টান্নাদি করে ভোগ দেওয়া হবে, আমি প্রসাদ পাব। এই আর কি।’
মাঝে মাঝে আবার নিজের জন্মতিথির কথা খেয়ালও থাকত না তাঁর। একবার জন্মতিথিতে, মা তখন কলকাতায় গঙ্গাস্নান সেরে, বাড়িতে ফিরে তিনি লক্ষ্য করেন যোগীন-মায়ের ব্যস্ততা। মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এসব কি গো যোগেন? মায়ের দিকে একটু চেয়ে থেকে, গভীর প্রীতির সঙ্গে মায়ের চিবুক স্পর্শ করে যোগীনমা বললেন, আজ যে তোমার জন্মতিথি, মা!’ মা হেসে বললেন, ও মা তাই?
জগদ্ধাত্রী পুজোর কিছু দিন পরেই মায়ের জন্ম হয়। স্বপ্নাদেশ পেয়ে শ্যামাসুন্দরী দেবী জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিলেন। তাই এই সময়টা সচরাচর জয়রামবাটি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতেন না মা, জন্মতিথির বেশির ভাগ সময়েই জয়রামবাটিতে কাটত। সেখানে যখন তাঁর জন্মতিথি পালনের তোড়জোর চলত, তখনও মুখ্য ভূমিকা নিতেন তিনিই। আত্মীয়রা যাতে জন্মতিথিতে কোনও কারণে অসন্তুষ্ট না হয়, সে দিকে সজাগ নজর রাখতেন মা। আবার, গ্রামবাসীরাও যাতে মনঃক্ষুণ্ণ না হয়, সেই দিকে দৃষ্টি রেখে সাধ্যমতো আয়োজন করতে হত উৎসবের। সামান্য মানুষের সাধ্য কী, এমন ভাবে সব দিকেই ভারসাম্য রক্ষা করা!
তাঁর জীবৎকালে শেষ জন্মতিথিটি হয়েছিল ১৯১৯ সালে। সেবার মায়ের শরীর ভাল ছিল না। স্বামী পরমেশ্বরানন্দ যার বর্ণনা, “তাঁর শুভ জন্মতিথির দিন উপস্থিত হইলে শ্রীশ্রীমা বেশি ঝঞ্জাট করিতে নিষেধ করিয়া বলিলেন, ভক্ত ছেলেগুলি যারা আছে আর প্রসন্ন, কালীদের বাড়ির সবাইকে বলে দাও।“ সেই শেষ জন্মতিথির উৎসবেও দেবী আর মাতৃসত্ত্বা মিশে গিয়েছে। সেদিন অল্প তেল মেখে সামান্য গরমজলে গা মুছে, শরৎ মহারাজের পাঠানো শাড়ি পরে মা চৌকিতে বসার পরে একে একে সবাই পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করতে থাকেন। স্বামী পরমেশ্বরানন্দ মাকে একটি গাঁদাফুলের মালা পরিয়ে প্রার্থনা জানান- যে ভক্তরা তাঁর সাক্ষাৎ দর্শন পায় না, তিনি যেন তাঁদেরও মঙ্গল করেন। তখনও কেউ জানতেন না, মা অচিরেই চলে যাবেন। কেউই আর তাঁর সাক্ষাৎ দর্শন পাবে না। ১৯২০ সালে জন্মতিথি আসর অনেক আগেই মা রামকৃষ্ণলোকে পাড়ি জমান।
শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য ও ভক্তদের নিজের সন্তান বলে মনে করতেন সারদা মা। প্রতিদিন অগণিত ভক্ত বাগবাজারে তাঁর দর্শন, উপদেশ ও দীক্ষালাভের আশায় ভিড় জমাতেন। তাঁর মাতৃসমা মূর্তি ও মাতৃসুলভ ব্যবহার সকলকে মানসিক শান্তি দিত। বলা হয়, কয়েকজন শিষ্য তাঁর দর্শনলাভের পর আধ্যাত্মিক অনুভূতিপ্রাপ্ত হন, অনেকে তাঁর সাক্ষাৎ দর্শনে দেবীরূপে তাঁর দর্শনলাভ করেন। আবার কেউ স্বপ্নে তাঁর থেকে দীক্ষালাভ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর সারদা দেবীকে ঠাকুরের শিষ্যেরা নিজেদের জননীর আসনে বসিয়েছিলেন। তাঁর উপদেশ ও উৎসাহ লাভের আশায় তাঁরা বারবার ছুটে আসতেন। স্বামী নিখিলানন্দ, স্বামী অশেষানন্দ, স্বামী বিরেশ্বরানন্দ এবং স্বামী বিরজানন্দ ছিলেন তাঁর প্রধান শিষ্য। নারীশিক্ষায় বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন সারদা দেবী, ভগিনী নিবেদিতাকে তাঁর নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন।
সারদা দেবী রামকৃষ্ণ সংঘ ও ভক্তসমাজে সর্বাধিক শ্রদ্ধার আসনটি লাভ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁকে নিজের প্রয়াণের পর রামকৃষ্ণ আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভক্তদের বলেছিলেন সারদা দেবীই সব। নিজেও তো ফলহারিণী অমাবস্যায় পুজো করেছিলেন। আদপে তিনিই ছিলেন সাক্ষাৎ জগদম্মা যার স্বরূপ রামকৃষ্ণ দেব উপলব্ধি করেছিলেন। ঠাকুরের সন্তানদের পথপ্রদর্শক হয়ে তিনিই এগিয়ে দিলেন রামকৃষ্ণ আন্দোলনকে। যা তার ব্যাপ্তি আমাদের মুগ্ধ করে। সন্তানদের বেঁধে রাখার সুতো হয়েই রামকৃষ্ণ মঠ মিশন এবং রামকৃষ্ণ আন্দোলনের বুনোট মজবুত করে গিয়েছেন মা।
মৃত্যুর আগে এক শোকাতুরা শিষ্যাকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন, যদি শান্তি চাও, মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেখ। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার। আসলে তিনিই তো জগন্মাতা, শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিতে। পৃথিবীকে লালন করতে, ধারণ করতেই তাঁর আগমন। তাই তো তিনি সতের মা, অসতেরও মা, সত্যিকারের মা, জননী। পরবর্তীতে পাঁচের দশকে মায়ের নামে তৈরি হয়েছে সারদা মঠ, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মতোই সেবাব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছে সারদা মঠ।