বিনোদন বিভাগে ফিরে যান

সুফিবাদ থেকে ‘ছাইয়া ছাইয়া’, বলিপাড়ার গানে আধাত্ম্যবাদ ফিরিয়ে আনেন এ আর রহমানই?

January 6, 2023 | 3 min read

শ্রম লাঘব থেকে যন্ত্রনা নাশ, সঙ্গীতের ক্ষমতা অসীম। সুর মিশে থাকে মনসংযোগের আকুতি। ঈশ্বরের নামে আজও ওস্তাদ-পন্ডিতরা সুর-সাধনা করেন। কীর্তন, পদাবলী কীর্তন, পালাগানে, মঙ্গলকাব্যেও ঈশ্বর সাধনা পরিলক্ষিত হয়। আবার উনিশ শতকের ব্রহ্মসঙ্গীতে উঠে এসেছিল নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনা। রবীন্দ্রনাথ থেকে বিবেকানন্দ সকলকেই ব্রহ্মসঙ্গীতে খুঁজেছেন ঈশ্বরকে, রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনায়, পূজা পর্যায়ের গানে, ঈশ্বরের জন্য প্রার্থনা-আকুতি আলাদা আঙ্গিকে ধরা দিয়েছে। আবার সঙ্গীতের মাধ্যমে সকার ঈশ্বরের আরাধনা করেছেন রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণেরা। 

সুর আর স্বরের মেলবন্ধনে অতীন্দ্রিয়তার জন্ম হয়। আত্মস্থ হয় কথা, মননে প্রোথিত হয় অর্থ, আর তখনই সুর ধ্বনিতে ঈশ্বরের আবির্ভাব হয়। তখন সুর স্রষ্টাকে কী আর নিছক গায়ক বা সুরকার পরিচয়ে বেঁধে রাখা যায়! তখন তিনি হয়ে ওঠেন সাধক। তেমনই এক সাধকের জন্মদিন আজ।

পৃথিবীতে সঙ্গীতের মাধ্যমে ঈশ্বর সাধনা বহুকাল থেকেই হয়ে আসছে। সুরে বারবার ধরা পড়েছে ঈশ্বরের আরাধনা। উপমহদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। লালন সাঁইজি আজ থেকে দু-আড়াইশো বছর আগে পথ দেখিয়েছিলেন। ধর্মতত্ত্ব-দেহতত্ত্ব মিশে গিয়েছিল তাঁর গানে, দর্শন ধরা দিয়েছিল অনন্য ছোঁয়ায়। তাকে পরমেশ্বরের সাধনা ছাড়া আর কী নামে অভিহিত করব!

গানের এক নিজস্ব ভাষা রয়েছে, তাতে মানুষ থেকে প্রাণী সকলেই আকর্ষিত হন। পল বার্টনের পিয়ানো শুনে হাতিও কেঁদে ফেলে, ম্যাকাউ তাকে ঘিরে ধরে, সে দৃশ্য মনে নেই? সঙ্গীতে ক্ষত সারে, মানুষ দুঃখ ভোলে, রোগের উপশমে আজ মিউজিক থেরাপি ব্যবহৃত হচ্ছে। সঙ্গীতে শ্রমলাঘব হয়। মাঝিমল্লা, বেহারারা তো গানেই শ্রমের কষ্ট ভুলে থাকতেন। কল বসানোর গান, ছাদ পেটানোর গান, সত্যিই গানে যাদু আছে। যে সঙ্গীতে এতো কিছু হয়, সেই সঙ্গীতে ঈশ্বরের সাধনা হবে না?

পল্লীবাংলার বাউল গান, মুর্শীদি-সারী গান তো ঈশ্বর সাধনার কথাই বলে। মধুকরী, ঈশ্বর সাধনা আর গান এক অদ্ভুত মিশেলের নাম। পীর-দরবেশদের সেই আঙ্গিককে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সঙ্গীতে নিয়ে আসার কারিগরের নাম আল্লারাখা রহমান। 


এই সুর সাধক সুফিবাদকে মূলধারার ভারতীয় সঙ্গীতে নিয়ে এলেন। ইসলামি দর্শন হল সুফিবাদ। কিন্ত বিভিন্ন ধর্মের দর্শন কী আলাদা? সব ধর্মের কথাই তো এক, মানব সেবা, মঙ্গলময় পরমেশ্বরের কাছে আত্ম নিবেদন। সুফিবাদও তাই। আমরা মিথ্যে লড়াই করি, যে লড়াইয়ের কোন সারবত্তা নেই। সুর হল শব্দ ব্রহ্ম আর সেই শব্দ ব্রহ্মের কোন জাত হয় না। 
লালন বলে গিয়েছেন-
জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা।
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তা না না না।।
আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে।
কি জাত হবা যাবার কালে
সেই কথা ভেবে বলো না।।
ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি
এক জলে সব হয় গো শুচি।
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কাউকে ছাড়বে না।।
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়।
লালন বলে জাত কারে কয়
এই ভ্রম তো গেল না।।
এটাই তো ধর্মতত্ত্ব, ধর্ম তো সম্প্রীতির কথাই বলে যায়। সেই সম্প্রীতিই ধরা দিয়েছে রহমানের সৃষ্টিতে। সুফিবাদকে ব্যবহার করে, সুর ও স্বরে তিনি ঈশ্বরের আহ্বান করেছেন। অন্তর আত্মায় ঈশ্বরকে অবস্থান করতে বলছেন। সম্প্রীতির কথা বলেছেন।

ভারতীয় সিনেমায় শ্রেষ্ঠ সুফি সঙ্গীতের কথা মনে করুন। একটি গানের কথাই মনে আসে। রহমানের আরও কয়েকটি গানের কথা লিখবো, যেগুলি শুনলে মনে হয়, এ গান ঈশ্বরের সাধনার জন্যই সৃষ্টি, সুর আর আধ্যাত্মবাদ মিশে যায়। যেন ঈশ্বর নেমে আসেছেন। এক অদ্ভুত প্রস্বস্তি।

খাজা মেরে খাজা: 


এ গান অমরত্ব পেয়ে গিয়েছে, সঙ্গীত,সুফিবাদ যতদিন থাকবে এ গানও ততদিন থাকবে। সুর এবং কণ্ঠ দুটোই রহমানের। যোধা আকবর ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে গানটি। মনে হয় না কোন সঙ্গীতস্রষ্টা সুফিয়ানাকে এমনভাবে ধরতে পেরেছেন।
প্রাণ ঢালা গান। মইনুদ্দীনকে হৃদয়ে মিশিয়ে নেওয়ার আহ্বান। এক আত্মিক সমর্পন, আজও মুগ্ধ করে শ্রোতাদের।

পিয়া হাজি আলী: 


ছবির নাম ফিজা। সর্বশক্তি মানের উদ্দেশ্যেই গান বাঁধলেন রহমান। হাজি আলীর জন্য ফের এক প্রাণ ঢালা গান। এ গান শুনলে মনে হয়, বাবা হাজি আলীর মাজারে গিয়ে এক কাতর ডাক যেন কড়া নাড়ছে। সঙ্গে জুড়লেন ঈশ্বরের স্বরূপ-দর্শন, হিন্দু-মুসলিম- শিখের বেঁধে থাকার বার্তা।

কন ফায়া কন: 


নিজামুদ্দিনের প্রতি প্রার্থনায় সৃষ্টি করলেন সুর। ব্যবহার হল রক স্টার সিনেমায়। এমন গানও খুব কম তৈরি হয়েছে ভারতীয় চলচ্চিত্রে, সুর-তাল-লয়ে ধরা দিল সুফিয়ানা। জাভেদ আলী, মোহিত চৌহানের সঙ্গে কণ্ঠও দিলেন রহমান। 

রোশান হুয়ি রাত: 


স্বপ্নে ছবির এক অসামান্য গান। দৃশ্যে রয়েছে চার্চে পরমপিতার প্রতি প্রার্থনা করছেন ছবির নায়িকা কাজল। এই সঙ্গীতটিও রহমানের তৈরি করা। এক আশ্চর্য আকুতি বারবার ধরা দিয়েছে রহমানের গানে, যা হৃদয়বিদারক। হয়ত সেই কারণেই তাঁর সুর আমাদের হৃদয়ের এতো কাছাকাছি পৌঁছয়। তাঁর নিজের কথাতেই, ঈশ্বরের প্রতি আত্মনিমগ্নতাই এই ধরনের সুর সৃষ্টির কারণ।

মন মোহনা, ছোড়কে আপনি কাশী মথুরা: 


কৃষ্ণের আরাধনা, সেই ঈশ্বরের কাছে নিবেদন ধরা দিল এ গানেও। একই ছবি যোধা আকবর, একই ধর্ম দর্শন, প্রার্থনা তবে ইসলামী নয়, হিন্দুদের সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবতা কৃষ্ণকে নিয়ে গান বানালেন রহমান। সুরের অপার যাদুতে মিলে গেল দুই ধর্ম। এটাই তো ভারত, রফি গান ব্রজগোপী খেলে হরি, নজরুল লেখেন কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন আবার বিসমিল্লার সুরে পাঞ্জাব-সিন্ধু-দ্রাবিড়-বঙ্গ এক হয়ে ওঠে।

ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণের পরে যে সুর সৃষ্টি হয়, সেখানে আধ্যাত্মবাদের মিশেল তো হবেই। তাই তো তাঁর গান শুনলেই মনে হয় যেন, ঈশ্বরের সাথে সার্থক সংযোগ স্থাপনের এক চেষ্টা চলছে। সুরের মাধ্যমেই পরমেশ্বরের কাছে আশ্রয় মিলবে, এখানেই তাঁর সুর এক এবং অদ্বিতীয়। এখানেই তাঁর সৃষ্টির সার্থকতা।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Songs, #AR Rahman, #Sufi, #Sufi songs, #Chhaiya chhaiya, #Music, #Bollywood

আরো দেখুন