আজ টিনটিন-এর জন্মদিন, ৯৪-এ সোনালি ঢেউ খেলানো চুলের ক্ষুদে রিপোর্টার
সৌভিক রাজ
তুমি না থাকলে ছোটবেলা এতো মিষ্টি হত না, আজ টিনটিনের জন্মদিন। আজকের দিনেই সুদূর ফ্রান্সে সোনালি ঢেউ খেলানো চুলের ক্ষুদে রিপোর্টারটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। বাংলার টিনটিনের জনক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কিন্তু খাস বিলাতি টিনটিনের পাপা হলেন, বেলজিয়ামের কার্টুনিস্ট হার্জ। তবে তাঁর আসল নাম জর্জেস রোমি। ১৯২৪ সালে হার্জে এক মজার কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। নিজের নাম উল্টে দিয়েছিলেন। জর্জে রেমি হয়ে গেলেন রেমি জর্জে। সেখান থেকে প্রতিটি অংশের প্রথম অক্ষর নিয়ে তার লেখায় স্বাক্ষর করলেন আর জে নামে। ফরাসি ভাষায় এর উচ্চারণ হল হার্জ। তার আসল নাম চাপা পড়ে গেল।
বাঙালির ছেলেবেলা বড় মধুর। একদিকে ফেলু-টেনি-ঘনা আর অন্যদিকে বাটুল- হাঁদাভোঁদা-শঙ্কু-টিনটিন আহা সোনা ঝরা সে’সব দিন, মেলা আনন্দে মুড়ে থাকত আমাদের ছোটবেলা। আনন্দমেলা বাড়িতে আসার পরেই সেই আনন্দের হাট বসত। আনন্দমেলার পাতাতেই টিনটিন প্রথম বাংলায় বেরোতে শুরু হয়েছিল। এ দেশে বাংলাতেই প্রথম টিনটিনের রূপান্তর বেরিয়েছিল। যদিও ভারতে টিনটিন কোন অভিযান করেনি, তিব্বতে টিনটিন-এর সময় টিনটিন একটিবার দিল্লি ছুঁয়ে গিয়েছে। আজ যে টিনটিন আমার-আপনার মাতৃভাষায় কথা বলে, স্নোয়ি যে আজ কুট্টুস হয়েছে; এই সবই হয়েছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জন্য। নীরেন্দ্রনাথবাবুর কন্যা, এখন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের অধ্যক্ষা শিউলি সরকার, আনন্দমেলার অনুবাদ চাক্ষুষ করার অন্যতম সাক্ষী। তিনি একবার বলছিলেন, ‘‘বাবা কিন্তু মূল ফরাসির মিলু বা ইংরেজির স্নোয়ির সঙ্গে মিলিয়ে টিনটিনের কুকুরের নাম রাখতে চাননি। হাড়-রসিক সেই কুকুরের নামে একটা কামড়ের অনুষঙ্গ যোগ করতেই তা হল, কুট্টুস!’’
সেই সোনালি ঢেউ খেলানো চুলের ক্ষুদে রিপোর্টার টিনটিন, সঙ্গে তার প্রভুভক্ত কুকুর দুষ্টু কুট্টুস, আমাদের ঘরের লোক হয়ে উঠলো। কখনও কখনও সঙ্গে থাকত ক্যাপ্টেন হ্যাডক, ডিটেকটিভ রনসন-জনসন, প্রফেসর ক্যালকুলাস; জমে যেত আসর। এদের নিয়েই টিনটিনের মজাদার অ্যাডভেঞ্চারে গপ্পো। যা আমাদের দূর দেশে নিয়ে চলে যেত। পড়তে পড়তে টিনটিনের সঙ্গেই দেশ বিদেশ ঘুরে নিতাম সকলে। আমাদের তোপসে দাও টিনটিনের ফ্যান ছিল। আনন্দমেলার সম্পাদক হয়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যেন এক বিস্ময়ের পৃথিবীতে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের। ফেলু গপ্পে আমরা তোপসেকে টিনটিন পড়তে দেখছি। আদপে সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ ছিলেন টিনটিনের অনুরাগী, এ নেশাও বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন সন্দীপ। তোপসে অনেকটাই সন্দীপের প্রজেক্সান ছিল, তাই দুজনকেই টিনটিনে মিলিয়ে দিয়েছিলেন মানিক বাবু।
এ যুগে এসেও আনন্দ পাবলিশার্সের বাংলা টিনটিনের কাটতি জটায়ুর ভাষায় হট কেকের মতো। কলকাতার বাঙালি টিনটিনকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরিয়েছে। শহরের রেস্তরাঁয় টিনটিন-স্মারক, থিম-কেকে তার জন্মদিন পালন হয়। শহরে আস্ত একখানা রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে টিনটিনের নামে, টিনটিন অ্যান্ড দা ব্রাসেলস ক্লাব, Tintin and the Brussels Club !
কমিক স্ট্রিপের মাধ্যমে গল্প বলার ধরণকে ফ্রেঞ্চরা বন্ড ডেসিন বলত, যার পথিকৃৎ ছিলেন জর্জে রেমি। একাধিক কমিক চরিত্রের সৃষ্টি করলেও, তিনি টিনটিনের স্রষ্টা রূপেই জগৎ বিখ্যাত হয়ে আছেন। হার্জের ইচ্ছা ছিল তার সঙ্গেই টিনটিনের মৃত্যু হবে। সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়েই ৮৩-এর পরে আর নতুন করে টিনটিন লেখা হয়নি। ১৯৮৮ সালে টিনটিন ম্যাগাজিনটিও বন্ধ হয়ে যায়। টিনটিনকে নিয়ে মোট ২৪টি অ্যাডভেঞ্চারের গল্প লিখেছিলেন হার্জ। সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ইউরোপীয় কমিকসগুলির মধ্যে অন্যতম হল টিনটিন। টিনটিনকে বিংশ শতাব্দীর সেরা কমিক বলা যায়। পৃথিবীব্যাপী এর জনপ্রিয়তা, গল্পের প্রাণবন্ততাই টিনটিনের সাফল্যের আসল কারণ। ৫০টিরও বেশি ভাষায় টিনটিন অনূদিত হয়েছে। টিনটিনের গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র, নাটক, কার্টুন সিরিজও নির্মিত হচ্ছে।
বাঙালিও অনেকদিন ধরেই টিনটিনে মজেছে, সাড়ে নয় দশক পেরোতে চলল কিন্তু আজও অক্ষত টিনটিনের জনপ্রিয়তা। টিনটিনের রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনী এবং টিনটিনের রসবোধ একে বাঙালির আপনজন করে তুলেছে।