রাজ্য বিভাগে ফিরে যান

বারাঙ্গনাদের বাণী বন্দনা

January 26, 2023 | 4 min read

সৌভিক রাজ

সরস্বতী পুজো মানেই শীতের ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে হলুদ মেখে স্নান সেরে অঞ্জলি দেওয়া। সরস্বতী পুজো মানেই বাঙালির ১৩ পার্বণের অন্যতম এক বড় পার্বণ। বিশেষ করে স্কুল-কলেজে এবং পড়ুয়াদের কাছে দিনটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যার দেবীর পুজো। শহর কলকাতার সব বিদ্যায়তন ঘটা করে সরস্বতী পুজো পালন করে। সরস্বতী বৈদিক দেবী। বাৎস্যায়ানের কামসূত্র মতে, সরস্বতী পুজোর দিন থেকে চৌষট্টি কলা শিক্ষার শুরু হয়। শাস্ত্রে বাগদেবীর বন্দনায় কামদেবের উল্লেখ পাওয়া যায় “বাগ্দেব্যৈ বিদ্মহে কামরাজায় ধীমহি, তন্নো দেবী প্রচোদয়াৎ।।” এককালে টোল পাঠশালায় পটে দেবীর পুজোর প্রচলন হয়েছিল। সেখান থেকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাবু সম্প্রদায়ের হাত ধরেই জাঁকজমকপূর্ণ সরস্বতী পুজোর প্রচলন হয়েছে। ১৮৭২ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘বাবু’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র লিখছেন, “যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন এবং পাঁঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।”

এই বাবুদের অনুকূল্যে বেশ্যাবাড়ি থেকেই কলকাতায় মহাসমারোহে সরস্বতী পুজোর প্রচলন হয়েছিল। পলাশী যুদ্ধের পরে ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা জমিয়ে যেসমস্ত বাঙালি প্রচুর উপার্জন করেছিলেন তারাই ইতিহাসে নববাবু নামে খ্যাত হয়েছিলেন। কলকাতার ইতিহাসে এমন নজন বাবুর কথা জানা যায়। এদের নিয়ে সেসময় সং বাঁধা হয়েছে। পূর্ণেন্দু পত্রী ছন্দে মোড়া কলকাতায় বাবুদের নিয়ে লিখে গিয়েছেন। বাবুদের খরচের হাত আর উপপত্নী পোষণের উপর সমাজে তাদের আভিজাত্য ও কৌলীন্য নির্ভর করত। এই উপপত্নীরাই ‘নববিবি’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। ১৮২৩ সালে প্রকাশিত ‘নববাবুবিলাস’ বলছে, ‘নববাবুরা প্রায় অনেকেই রাত্রে আপন ভবন পরিত্যাগ পূর্ব্বক বেশ্যাসদন গমন করিয়া বাস করেন, অতএব প্রতিদিন রাত্রিযোগে যোগের ও ভোগের অভিলাষে অন্যবাসে প্রবাস করিলে তাঁহার স্ববাসের সাধ্বীও অসাধ্বী হয়; তখন তাহাকে সাধ্য সাধনা করিলেও কাহার সাধ্য যে অবাধ্যাকে বাধ্যা করিয়া রাখে।’ এইভাবেই গড়ে ওঠে ‘নিষিদ্ধপল্লী’। কলকাতার বুকে যৌনপল্লীতেই আরম্বরপূর্ণ সরস্বতী পুজোর প্রচলন হয়। ১৮৬৫ সালে লেখা ভুবনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের “সমাজ কুচিত্র” নকশায় পাওয়া যাচ্ছে “কলকেতা শহরের সবই সৃষ্টিছাড়া। এখানে গৃহবাড়ির চেয়ে বেশ্যাবাড়ির পুজোর সংখ্যা ও জাঁকজমক শতগুণে অধিক”। নিষিদ্ধপল্লীতেই যে সরস্বতী পুজো বেশি হত তা তদানিন্তন সংবাদপত্র থেকেও জানা যায়।

যৌনপল্লীতেই যে সরস্বতী পুজোর প্রচলন হয়েছে তা সুলভ সমাচার থেকে জানা যায়, “বেশ্যাদের পক্ষে বিদ্যালাভের কামনা নিতান্ত অনধিকার চর্চা হইলেও তাঁহারা তাতে ধূমধাম করিয়া থাকে।” বেশ্যালয়ে সরস্বতী পুজো! রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। সরব হয়ে ১২৮০ সনের ১৫ মাঘ মঙ্গলবারের ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকা সমালোচনা করে এ-প্রসঙ্গে লেখেন, “হিন্দু পর্ব্বের মধ্যে কার্ত্তিক ও সরস্বতী পূজার প্রতি বেশ্যাদিগের কিছু অধিক অনুরাগ দেখিতে পাওয়া যায়। সন্তান কামনা করিয়া লোকে কার্ত্তিক পূজা করে এবং বিদ্যালাভের জন্য সরস্বতী পূজা করে। বেশ্যাদের পক্ষে এ প্রকার কামনা নিতান্ত অনধিকার চর্চ্চা, তথাপি তাহারা কার্ত্তিক ও সরস্বতী পূজায় খুব ধুমধাম করিয়া থাকে।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কাটোয়ায় বেশ্যাপল্লীর ন্যাংটো কার্তিক পুজো খুবই বিখ্যাত।
আর্য্যদর্শন’ পত্রিকায় বাঙালিদের উদ্দেশ্যে সশ্লেষে লেখা হয়, “সরস্বতী তোমার দুহিতা, কন্যাদায়ে তুমি সদাই বিব্রত, তাহাকে অন্যের ঘাড়ে ফেলিতে পারিলেই তুমি দায় হইতে নিষ্কৃতি পাও, তোমাকে নমস্কার।” কিন্তু কথায় বলে না, টাকায় কাঠের পুতুলও কথা বলে ওঠে। এক্ষেত্রেও তাইই হল পয়সায় সব রব থেমে গেল। পুজোরদিন বেশ্যালয়গুলো ভিড়ে ফেটে পড়ত। এতো সংখ্যায় পুজো হত যে মূর্তির জোগান দিতে কুমোরটুলির কুমোররা নাজেহাল। কালী সিংহীর হুতোম প্যাঁচার নকশা থেকে জানা যায়, “কুমোরটুলির নগ্দা সরস্বতীরা বেধড়ক বিক্রি হয়ে মুটের মাথায় উঠ্চেন, কুমোরেরা শেষকালে আর জোগাতে না পেরে, বাড়তি দোমেটে করা জগদ্ধাত্রী ঠাকুরুনের হাতি ও সিঙ্গি ভেঙে দুখানি হাত কেটে ও ঘাড় বেঁকিয়ে সাদা করে স্থান পূর্ণ কচ্চে।” গোটা যৌনপল্লীর রাস্তা জুড়ে পুজো হত।

অন্য পুজো পার্বনে বেশ্যালয়ে আসর বসলেও সরস্বতী পুজোতে বসত না। তবে পুজোর পরে বাবুরা আসতেন। বিবিরা তবলা বাজাতেন, বাবু ইঙ্গিতপূর্ণ গান করতেন। নানা কিছু হত, রঙ্গ রসের আসর জমত অন্যভাবে। সঙ্গে চলত সবান্ধব তাসখেলা ও মদ্যপান।

সেকালের কলকাতায় কোন কোন অঞ্চলে এমন সরস্বতী পুজো হত ‘সমাজ কুচিত্র’ নকশা থেকে তা জানা যায়। লেখা হচ্ছে, ‘এদিকে মাঘ মাস শেষ হয়ে এলো। ফাল্গুন মাসের প্রথম দিনেই মা বীণাপাণি পৃথিবীতে আবির্ভূতা হবেন। দশ দিন থাকতেই সহর যেন অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করচে, সোনাগাজী, বাগবাজার, সিমলা, মেছোবাজার, গরাণহাটা, বাঁশতলা, মাথাঘষা, চোরবাগান, সিদ্ধেশ্বরীতলা, চাঁপাতলা, হাড়কাটা, সেন্ট জেমস চর্চ্চ, বৌবাজার, গুড়ের মা, ইমামবাগ, চাঁদনী ও জানবাজার প্রভৃতি পীঠস্থান সকল যেন জম্ জম্ কচ্চে। দিন নাই, রাত নাই, ঝাঁক ঝাঁক পীল ইয়ারের দল ঐ সকল তীর্থে সমাগত হচ্চেন।’

চোরবাগান, সোনাগাছি, বাগবাজার, সিমলা, মেছোবাজার, গরাণহাটা, বউবাজার, চাঁদনি, জানবাজার, ইমামবাজার এসব অঞ্চলে তখন হাজার হাজার হিন্দু পতিতা বাস। ১৮৫৩ সালের সরকারি তথ্য বলে, কলকাতা শহরেই তখন প্রায় দশ হাজার হিন্দু পতিতা ছিল। এদের মধ্যে অধিকাংশই কুলীন ব্রাহ্মণের স্ত্রী। কিছুদিন আগেও যারা ছিল গৃহস্থ ঘরের বধূ ছিলেন। বেশ্যালয়ে পুজোর প্রচলন ভারী চমৎকারভাবে হয়েছিল। পুজোর আগের দিন বিকেলে বাড়ি-বাড়ি প্রতিমা সাজানো হচ্ছে দেখে এক নববিবির হঠাৎ পুজো করার কথা মনে পড়লো। সন্ধ্যায় বাবু আসতেই বিবি অভিমান ক’রে পুজোর আয়োজন করার আবদার করেন। বাবুর হাতে নগদ টাকা নেই। কিন্তু মান রাখতে হবে, তাই তিনি তাঁর পিতামাতার সিন্দুক ভেঙে দু’ছড়া চাঁদী কাটা পৈঁছা ও একটা সিঁদুরের চুপড়ি চুরি করে পুজোর ব্যবস্থা করে মান বাঁচান। বারবনীতাদের কথায়, বারাঙ্গনা সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই সরস্বতী পুজোর প্রচলন ছিল। কয়েক হাজার বছর ধরেই এই রেওয়াজ চলে আসছে। নাচ-গান-ছলাকলা, সব কিছুরই দেবী হলেন সরস্বতী।

শোনা যায়, ওইদিনই বেশ্যালয়ে বহু নতুন মেয়েকে বাবুভুলানো বিদ্যায় হাতেখড়ি দেওয়ানো হত। বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ও জানাচ্ছে কলকাতার যৌনপল্লীতেও বহু মেয়ের হাতেখড়ি হত এইদিন।​ ১৮৩০ সালে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নববিবিবিলাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় এই বিদ্যা, ছয় ‘ছ’ নামে পরিচিত ছিল। যেগুলো হল ছলনা, ছেনালি, ছেলেমি, ছাপানো, ছেমো আর ছ্যাঁচড়ামি। ছেমো মানে মেয়েলীপনা, ন্যাকামো। এই দিনেই নতুন মেয়েদের পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন নামে নামকরণ হত।
সমাজ কুচিত্র নকশায় রয়েছে “এদিকে বেশ্যালয়ে ছোট ছোট মেয়েদের তালিম দেওয়া আরম্ভ হল। তবলা, মন্দিরে ও তানপুরা বাজতে লাগল। কুমারীদের নাম ফিরিয়ে নাম রাখার এই এক সময়। জন্মভূমিতে যারা খুঁদী, চাঁপী, কুড়ুনী, সাগুড়ি ও ভূতি নামে বিখ্যাত ছিল, এখন তাঁদের নাম গোলাপ, টগর, কামিনী, আতর ও হেলেন্না হয়েছে।” এইভাবে যৌনপল্লীতে শুরু হওয়া পুজো বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। আর অন্যদিকে, যৌনপল্লীর বাণী বন্দনা ক্রমে ক্রমে লোপ পেল।

(হরিপদ ভৌমিকের কলির শহর কলকাতা বইটির প্রতি সবিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।)

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Sawaswati Puja, #prostitution

আরো দেখুন