সত্যজিতের ছবিতে বাঙালিয়ানা ও বাংলা ভাষার প্রতি দরদ উঠে এসেছে বার বার?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: গতকাল ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৩৫৮ সনের ৮ ফাল্গুন বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকারের আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন বরকতরা। সে কারণেই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। গতকাল ছিল বাঙালির ভাষা পুজোর দিন। দিনভর সমাজ মাধ্যম ভেসে গিয়েছে বাংলা ভাষা কেন্দ্রীক পোস্টে, বারবার উঠে এসেছে সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত বাইশে শ্রাবণ ও দ্বিতীয় পুরুষ ছবি দুটির কয়েকটি সংলাপ। কিন্তু বাংলা ছবিতে প্রথম ভাষাগত জাতীয়তাবাদ কি সৃজিতই নিয়ে এলেন? এ প্রশ্ন উঠেছে বারবার। উত্তর দিলেন স্বয়ং মানিকবাবু। সত্যিজিতের ছবিগুলো আদ্যন্ত বাঙালিয়ানায় ভরপুর। পল্লীগ্রাম থেকে শহর, গোটা বাংলা উঠে এসেছে সত্যজিতের ছবিতে। উঠে এসেছে বাঙালির ‘সেকেন্ড হোম’ কাশীর কথাও। অক্ষত রেখেছেন বাঙালিয়ানা। একই সঙ্গে বাঙালির জাতিসত্ত্বায় খোঁচাও দিয়েছেন মানিকবাবু। করে গিয়েছেন বাংলা ভাষার জয়গান।
নায়ক ছবিতেই দেখুন, শঙ্করদাকে দিয়ে মানিকবাবু বলাচ্ছেন, সাবেকি দুর্গা প্রতিমা ছাড়া ভক্তি আসে না। একে ষোলোয়ানা বাঙালিয়ানা ছাড়া আর কী বলব?
আবার নায়কে ট্রেনের মধ্যে অরিন্দম আর অদিতির প্রথম সাক্ষাৎ শুরু হচ্ছে-
- Excuse me, একটা অটোগ্রাফ?
- Oh, Yes. Certainly.
- আমার…..খুড়তুতো বোনের জন্য।
- হুমম, তাই বলুন, আপনাকে দেখে ঠিক সই নেওয়া
টাইপ বলে মনে হয় না। বাংলা ছবি দেখার বদ
অভ্যাস নেই বোধহয়? - খুব কমই দেখি।
- খুব খারাপ লাগে তো?
- বাস্তবতার একটু অভাব।
- ঠিকই বলেছেন, যেমন বি.এ. পাশ করা নায়িকার কখনোই বিরহে গান গাওয়া উচিত নয়।
- আর নায়ক হলেই দেবতুল্য লোক হওয়া উচিত নয়।
আসি, ধন্যবাদ।
বাঙালি যে বাংলা ছেড়ে, নিজেদের ঐতিহ্য, জাত্যাভিমান ভুলে ভিনদেশী জিনিসে মন-মজায়, সেই ঘটনাকে সশ্লেষে বিদ্ধ করেছেন মানিকবাবু।
গুপী-বাঘাতে গানের মাধ্যমে বাংলার জয়গান করলেন।
মহারাজা ! তোমারে সেলাম,
সেলাম, সেলাম।
মোরা বাংলাদেশের থেকে এলাম।
মোরা সাদা সিধা মাটির মানুষ, দেশে দেশে যাই,
মোদের নিজের ভাষা ভিন্ন আর ভাষা জানা নাই,
মহারাজা, রাজামশাই।
তবে জানা আছে ভাষা অন্য,
তোমাদের শুনাইয়ে ধন্য,
এসেছি তাহারি জন্য, রাজা।
মহারাজ!
মোরা সেই ভাষাতেই করি গান,
রাজা শোন ভরে মন প্রাণ।
এ যে সুরেরই ভাষা, ছন্দেরই ভাষা
তালেরই ভাষা, আনন্দেরই ভাষা
ভাষা এমন কথা বলে বোঝা রে সকলে
এমন কথা বলে বোঝা রে সকলে
উঁচা-নিচা ছোট বড় সমান
রাজা উঁচা-নিচা ছোট বড় সমান।
মোরা এই ভাষাতেই করি গান
এই ভাষাতেই করি গান
করি গান!
ফেলু ছবিতে মানিকবাবু বাঙালি আবেগকে ব্যবহার করলেন। সেই সঙ্গে মনে করালেন ভিন্ন ভাষাভাষীদের দেখা মাত্রই হিন্দিতে বাক্যালাপ করার প্রয়োজন নেই। ট্রেনে ফেলু তোপসের সঙ্গে জটায়ুর প্রথম সাক্ষাৎ হচ্ছে,
“তো আপ কাহা তক জা রহে হ্যায়?
-যোধপুর।
“ম্যায় ভি যোধপুর জা রহা হু। রাজস্থান কা পটভূমিকামে এক কাহানি লিখনা চাহতা হু। রহস্য-রোমাঞ্চ কাহানি। অব তক সাত্তাইশ কাহানি লিখি হ্যায়। অল পাবলিশড। ইয়ে হ্যায় মেরা সাম্প্রতিকতম্ উপন্যিয়াস। দুর্ধষ দুশমন। আপ ক্যায়া বাংলা পড়নে জানতে হো?”
-হাঁ। বোলনা ভি জানতা হু।
“তো কাহা শিখে?”
-কলকাত্তা। আপনি হিন্দি চালিয়ে যেতে পারেন। বেশ লাগছে।
“আরে দুররররর মশাই। আমি গড়পারের লোক। হিন্দি কি কেউ সাধে বলে নাকি?”
মন্দার বোসকে দিয়ে ‘কদিনের জন্যে বিদেশ গিয়ে বাংলা ভুলে গেছি’ শ্রেণীর উদ্দেশ্যে সত্যজিৎ বলাচ্ছেন, “বিদেশে গিয়ে আপনি যদি বাংলা ভুলতে চান তো তিন মাসেই ভুলতে পারেন, নয়ত ত্রিশ বছরেও ভুলবেন না”।
জয়বাবা ফেলুনাথে পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানা, প্রবাসে পুজো, ক্যালকাটা লজে থাকা, কাশীতেও মাছ পাতে পড়ার আকাঙ্খা। মগনলাল ভাঙা ভাঙা হিন্দি-বাংলা বললেও ফেলু দিব্যি বাংলা চালিয়ে গেলেন। গুণময় বাগচীকে বললেন, “কাশীতে এসে বিশ্বনাথের মন্দির তো সবাই দেখে, বিশ্বশ্রীর মন্দির ক’জন দেখতে পায়?” এটাও তো জাত্যাভিমান। বাঙালি হয় বাঙালির জয় উপভোগ করার বহিঃপ্রকাশ।
এরপরেই এসে পড়ে শেষ ছবি আগন্তুকের কথা। ‘অতিথি যে নারায়ণ’, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগে সে সত্যি উপলব্ধি করিয়ে গেলেন মানিকবাবু। বিশ্বায়ণ শুরু হব হব করছে, এমন সময় এসে ধর্ম, সভ্যতার আদত মানে বুঝিয়ে দিলেন মনমোহন মিত্র। গয়না বড়ি দেখিয়ে তুলে ধরলেন গ্রামবাংলার সংস্কৃতি। সংলাপে সত্যজিৎ আবারও বাংলা ভাষার জয়গান করে গেলেন। মায়ের ভাষা যে ভোলা সম্ভব না, সে বার্তাই দিলেন। উৎপল দত্তকে দিয়ে বলালেন, “মায়ের ভাষা ভুলতে না চাইলে কেউ ভোলেনা।”