কলকাতার ট্রামের ইতিহাসে-ইতিহাসে কলকাতার ট্রাম
সৌভিক রাজ
কলকাতা শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ট্রাম। কলকাতার ট্রামের কথা জানতে, প্রায় ১৫০ বছর পিছিয়ে যেতে হবে। সেকালের কলকাতা কিন্তু আজকের মতো ছিল না। ধীরে ধীরে কলকাতায় বৃদ্ধি পাচ্ছিল যানবাহনের চাহিদা। তখনই ব্রিটিশ প্রশাসনের মাথায় আসে ট্রামের ভাবনা। উনবিংশ শতকের শেষভাগ। শিয়ালদহ থেকে তৎকালীন সার্কুলার রোড ধরে বউবাজার, ডালহৌসি হয়ে একেবারে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত লাইন পাতার কাজ শেষ হল। প্রথমে খরচ ধরা হয়েছিল লাখখানেক টাকা। কিন্তু কাজে নেমে তা কয়েক বেড়ে যায়। দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন জাস্টিস অব পিস। প্রথম ট্রাম রুটের যাত্রাপথ ছিল ৩.৯ কিলোমিটার। অস্ট্রেলিয়া থেকে সব তেজি ঘোড়া নিয়ে আসা হল। মূলত পণ্য পরিবহণের জন্য চলবে ট্রাম, তেমনটাই ঠিক ছিল। কিন্তু ততদিনে ট্রামকে ঘিরে বাঙালির মধ্যে উদ্দীপনা চরমে। ট্রাম চালানোর দিনক্ষণ ঠিক হয়েছিল ১৮৭৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। এর চারদিন পরে কলকাতার রাজপথে গড়াল ট্রামের চাকা।
২৪ ফেব্রুয়ারি, সকাল ৯টা নাগাদ শিয়ালদহে এসে পৌঁছল ইস্টবেঙ্গল রেলওয়ে। কাতারে কাতারে লোক দৌড়ল ট্রাম ধরতে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তখন দু’টো এক বগির ট্রাম। একটা সেকেন্ড ক্লাস, অন্যটা ফার্স্ট ক্লাস। সাধারণ মানুষ উঠে পড়ল দ্বিতীয় শ্রেণিতে। তিল ধারণের জায়গা নেই। প্রথম শ্রেণিতে জনা পাঁচেক সাহেব। ফার্স্ট ক্লাস ট্রাম অনায়াসেই যাত্রা শুরু করল। কিন্তু বিপত্তি দ্বিতীয় ট্রাম নিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার তেজি ঘোড়া সেটি আর টানতে পারছে না। শেষে ঘোড়াকে চাবুক মেরে চালানো হল দ্বিতীয় শ্রেণির ট্রাম। এভাবেই পথ চলা শুরু কলকাতা তথা গোটা এশিয়ার প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রামের। কলকাতার প্যাচপ্যাচে গরমে অস্ট্রেলিয়ার তেজি ঘোড়াও কাবু হয়ে পড়ছিল। অবলা প্রাণীর মৃত্যুতে ক্ষতির বহর এতটাই বেড়ে যায় যে জাস্টিস অব পিস হাত তুলে নিল। ওই বছরের ২০ নভেম্বরই থমকে গেল সেই ট্রাম। পরবর্তীতে ১৮৮০ সালের ২২ ডিসেম্বর লন্ডনে ট্রামওয়ে কোম্পানি স্থাপিত হওয়ার পর ফের কলকাতার বুকে চলে ট্রাম। বছর সাতেক পর শহরে ফিরে আসে ঐতিহ্যবাহী যান।
তবে কিছুদিন স্টিম ইঞ্জিনে চালিত কলের ট্রাম চলেছে কলকাতায়। কিন্তু ধোঁয়া আর খরচের বহরে গোড়াতেই তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ততদিনে কলকাতায় বিদ্যুৎ সংযোগ চলে এসেছে। ১৮৯৮ সালে ট্রাম কোম্পানি জানিয়ে দেয়, বিদ্যুতে না চললে, ট্রাম চালানো সম্ভব নয়। বছর দুয়েক পর শুরু হয় বৈদ্যুতিকরণের কাজ। সেই সঙ্গে ন্যারো গেজের ট্রাম লাইনও বদলে ফেলা হয় চার ফুট সাড়ে আট ইঞ্চির ট্র্যাকে। ১৯০২ সালের ২৭ মার্চ তিলোত্তমার মাটিতে চলল গোটা এশিয়ায় প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম। ধর্মতলা থেকে খিদিরপুর। ময়দানের পাশ দিয়ে। মাস তিনেকের মধ্যে ধীরে ধীরে কালীঘাট পর্যন্ত এই পরিষেবা বাড়ানো হয়। এমনকী ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজার ইলেকট্রিক ট্রাম চলে সেই বছরেই। তখনও কিন্তু শিয়ালদহ, ওয়েলিংটন, মৌলালি ও ডালহৌসি রুটে বাষ্পীয় ট্রাম চলছে। এমনকী ঘোড়ায় টানা ট্রামও দেখা যায় হাওড়া, হাইকোর্ট, চিৎপুরের দিকে। ব্রিটিশ ট্রামওয়েজ কোম্পানির হাতে তখনও ৭০টি ট্রাম, ৭০০ ঘোড়া মজুত ছিল। আস্তে আস্তে সেগুলির দিন শেষ হয়। সর্বত্র বসে বিদ্যুতের খুঁটি। বৈদ্যুতিক ট্রামের জন্য নতুন বগি আনা হয়। আলাদা করে চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে কোম্পানি। এক বছরের মধ্যেই ট্রাম লাভের মুখ দেখল। অসম্ভব জনপ্রিয়তাও পেল। ঘোড়ার আস্তাবলের বদলে নতুন ট্রামের জন্য তৈরি হল ডিপো। শ্যামবাজার, কালীঘাট, খিদিরপুর, শিয়ালদহ প্রভৃতি জায়গায় গড়ে উঠল ডিপো।
এ শহরের অন্ধকার দিনেও পাশে ছিল ট্রাম:
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেয় মুসলিম লিগ। সেই সময়ে দাঙ্গা আক্রান্ত শহরবাসীর কাছে সম্প্রীতির বার্তা দিতে ধর্মঘটে শরিক হয়েছিলেন ট্রাম শ্রমিকরা।
আন্দোলনের কথা বলে ট্রাম:
একদা ট্রামের দুটো শ্রেণী ছিল। স্বাধীনতার পরেও অনেকদিন ট্রাম কোম্পানি ব্রিটিশের মালিকানাধীন ছিল। ব্রিটিশ ট্রাম কোম্পনি ১৯৫৩ সালের ২৫ শে জুন ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণীর ভাড়া এক পয়সা বৃদ্ধি করে, সেই মর্মে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। যার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে বামেরা। শহরের রাস্তায় ট্রাম পুড়িয়ে বিক্ষোভ দেখায় ক্ষুব্ধ জনতা। সেই আন্দোলনে কেঁপে উঠেছিল কলকাতা। নেতৃত্বে ছিলেন সুবোধ ব্যানার্জী, সুরেশ ব্যানার্জী, ফরওয়ার্ড ব্লকের হেমন্ত বসু আর অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জ্যোতি বসু। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সরকার কড়া হাতে আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। জ্যোতি বাবুরা সে সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এর অনেক পরে ট্রাম রাষ্ট্রায়ত্ত হয়েছিল।
বনলতা সেন নয়, জীবনানন্দকে চিরশান্তি দিয়েছিল ট্রাম:
১৯৫৪ সালের ১৪ শে অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন কবি জীবনানন্দ দাশ। ঐ দুর্ঘটনার কারণেই ২২ শে অক্টোবর শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৪ই অক্টোবর থেকে ২২ শে অক্টোবর পর্যন্ত শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিজের জীবনের শেষ হেমন্ত যাপন করেছেন কবি। যদিও অনেকেই এই দুর্ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে মনে করেন।
ট্রাম সংকট:
সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হলের মতোই এ শহর থেকে উধাও হয়েছে অনেক ট্রাম। এখন প্রায় সাতটি রুটে মোট ৩৫টির মতো ট্রাম চলে। কলকাতায় ট্রাম প্রথম বাধা পায় সাতের দশকের শেষে। মেট্রোর সুড়ঙ্গ তৈরি শুরু হলে জমি হারাতে থাকে ট্রাম। ১৯৯২ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের পরিবহণমন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তীর আমলে আয় বাড়াতে ট্রাম সংস্থা বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সময় থেকেই ক্রমবর্ধমান গাড়ির জট এড়াতে বিভিন্ন রাস্তায় উড়ালপুল তৈরি শুরু হয়। টান পড়ে ট্রাম-পথে। শুধু তাই নয়, রাস্তার ধার থেকে ট্রাম লাইন সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মাঝপথে। ফলে যাত্রীদের অনায়াস ট্রামে ওঠানামা দুরূহ হয়ে যায়। যাত্রী হারানোর সেই শুরু।
ট্রামের যত্ন নেন যারা:
শহরের ঐতিহ্যবাহী ট্রামকে বাঁচাতে এই শহরেই গড়ে উঠেছে ‘কলকাতা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশন’। ট্রাম সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে তারা একাধিকবার রাস্তায় নেমেছেন।
ট্রাম মিউজিয়াম:
২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একটি অভিনব উদ্যোগ নেয় সিটিসি, ওই দিন উদ্বোধন করা হয়েছিল স্মরণিকা ট্রাম মিউজিয়ামের। দেড়শ বছরের ট্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরতে ধর্মতলা ডিপোতে অভিনব মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে যা কলকাতার ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন। দু’কামরার ট্রাম ‘স্মরণিকা’র প্রথম কামরায় একটি এসি ক্যাফেটেরিয়া আছে। সেখানে টিকিট কেটে কিছু ক্ষণ সময় কাটাতে পারেন উৎসাহীরা। পাশের কামরায় থাকা মিউজিয়ামে বিভিন্ন স্মারকের মাধ্যমে কলকাতার ট্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা ছাড়াও অনেকেই নিয়মিত আসেন। এটিই দেশের একমাত্র ট্রাম মিউজিয়াম।