বাঙালির মিষ্টি সফর: রসগোল্লাপ্রেমী বাঙালির পাতে এককালে ব্রাত্য ছিল ছানা?
সৌভিক রাজ
সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক-এ ছোট মামা অর্থাৎ মনমোহন মিত্র বলেছিলেন আহারের এতো বাহার এ শুধু বাংলা দেশের পক্ষেই সম্ভব। সে কথা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্য ভোজন-বিলাসী বাঙালির খাদ্যপ্রীতি তা প্রমাণ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। সুগার প্রেসার কোলেস্টেরল ইত্যাদি যেকোন রোগকেই বাঙালি সোজা ব্যাটে “বাপি বাড়ি যা” করে দিতে পারে যেকোন ভাল খাবারের বিনিময়ে। সুনীল গাঙ্গুলী লিখেছিলেন কবিতার জন্য অমরত্বকে ত্যাগ করতে পারেন তিনি, আর বাঙালি কেবলমাত্র ভাল রসনার জন্য যেকোন কিছুর ত্যাগ করতে পারে। মিষ্টি নিয়ে সৈয়দ মুস্তফা আলি তাঁর ভ্রমন কাহিনী জলে ডাঙায়-তে লিখেছিলেন, আমরা তেঁতো, নোনা, ঝাল, টক, মিষ্টি এই পাঁচ রস দিয়ে ভোজন করি। ইংরেজরা খায় মিষ্টি আর নোনা, ঝাল সামান্য, টক তার চেয়ে কম এবং তেঁতো জিনিস যে খাওয়া যায় ইংরেজের সেটা জানা নেই। তাই ইংরেজি রান্না আমাদের কাছে ভোঁতা এবং বিস্বাদ বলে মনে হয়। অবশ্য ইংরেজ ভাল কেক-পেস্ট্রি-পুডিং বানাতে জানে –তাও সে গিয়েছে ইতালিয়ানদের কাচ থেকে এবং একথাও বলবো আমাদের সন্দেশ রসগোল্লার তুলনায় এসব জিনিস এমনকি, যে নাম শুনে মুর্ছা যাবো। বাঙালির খাদ্য-প্রীতি কোনও নতুন গজিয়ে ওঠা ঘটনা নয়, আশুতোষ মুখার্জী থেকে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ থেকে সুভাষ সকলেই ছিলেন ভোজন বিলাসী। মিষ্টি প্রীতিতেও এঁরা কম যেতেন না। কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন, এই তেরো পার্বনের একটিও সম্পূর্ন হয় না মিষ্টির অনুপস্থিতিতে, শেষ পাতে দই মিষ্টির হাজিরা বাধ্যতামূলক। বাংলায় যেকোন কাজ মিষ্টি ছাড়া অসম্পূর্ন। বাঙালির সব অনুষ্ঠানেই মিষ্টির অবাধ প্রবেশ, এমনকি মৃতদেহ দাহ করে ফিরেও বাঙালির মিষ্টিমুখের রেওয়াজ বাংলায় বিদ্যমান বহুদিন ধরেই। আজকে বাংলার যেকোন মিষ্টির দোকানে রকমারী মিষ্টির আনাগোনা, নতুন পুরানো মিলিয়ে হরেক রকম মিষ্টি। এই মিষ্টির জয়যাত্রার শুরুটা কিন্তু এত সুন্দরভাবে হয়নি।
দুধের মিষ্টি ছিল ব্রাত্য, সাফ কথায় ছানার ঠাকুরঘরে ঢুকত না। ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরনো মিষ্টিটি হল লাড্ডু, যার জন্ম আনুমানিক ২০০০ বছর আগে। লাড্ডু-মন্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত শব্দ লাড্ডুকা বা লাত্তিকা থেকে যার অর্থ হল ছোট গোলাকার বল জাতীয় বস্তু। ভারতবর্ষে এবং বাংলায় একাধিক উপাদান দিয়ে এই লাড্ডু তৈরি করা হত। বাংলার মিষ্টি বলতে মুলতঃ রসগোল্লা বা সন্দেশ, যার জন্ম গত দু’শো-আড়াইশো বছর পূর্বে। তার আগে বাংলায় মিষ্টি বলতে ছিল দুধ জ্বাল দিয়ে প্রস্তুত করা ক্ষীর, চিনি থেকে প্রস্তুত বিভিন্ন প্রকার শক্ত চিনির ডেলা জাতীয় মিষ্টি এবং গুড়। মিষ্টি শব্দটিকে বাঙালিরা এতটাই ভালোবেসে ফেলেছে যেকোন অনুষ্ঠানেই একে ছাড় দেওয়া হয় না, যা আর কোন খাবারের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। তাই শুধু বসনাতেই আটকে থাকেনি মিষ্টি, অজান্তে ভক্তি ও আধ্যাত্মবাদকেও আপন মহিমায় জয় করে ফেলেছে মিষ্টি। আদি সংস্কৃত সাহিত্য মূলতঃ ভোগ এবং ভোগ এই দুই উপলক্ষ্যে মিষ্টির ব্যবহারের উল্লেখ আছে। তাই ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হল মিষ্টি।
হাজার বছর আগের বাংলা সাহিত্যের প্রাথমিক প্রামান্য দলিল হিসাবে পরিচিত চর্যাবদে উল্লেখ রয়েছে প্রাকৃত বাঙালির পছন্দের খাবার হল কলাপাতায় “ওনানারাভতা গাইক ভিক্তা” এর অর্থ হল গাওয়া ঘি দুধ আর সরুচালের তৈরি পরমান্ন। যদিও এটি মিষ্টি নয় মিষ্টান্নের তালিকায় অর্ন্তভুক্ত। তবে স্বাদে মিষ্টি।
মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যে রসগোল্লার উল্লেখ পাওয়া যায় না। দুধ থেকে বিযুক্ত করে ছানা তৈরির যে প্রক্রিয়া সেই সময় বাংলায় প্রচলিত ছিল, তা হিন্দু ধর্মীয় চেতনায় নিষিদ্ধের পর্যায়েই ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে মধ্যযুগীয় বাংলার অন্যত্ম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ এর লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজ দধি, দুধেরসর ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও তিনি দুগ্ধ লকলকি, সরভাজা সরগুলি দুগ্ধমারি এমনাকি সন্দেশের কথাও উল্লেখ করেছেন। এইসব সন্দেশ বলতে মূলতঃ শর্করা জাতীয় সন্দেশ বা যতদূর সম্ভব চিনির ডেলা পাকানো গোলাকে বুঝিয়েছেন। প্রথমদিকে ছানা ও ছানার মিষ্টি একরকম ব্রাত্যই ছিল, বঙ্গসমাজে ডঃ সুকুমার সেন তাঁর ‘কলকাতা কাহিনী’ বইয়ে লিখেছেন “ক্ষীর-মাখন-ঘি-দুই” এগুলি ছিল কাঁচা দুধের স্বাভাবিক অথবা কৃত্রিম পরিনাম, কিন্তু কখনোই দুধের বিকৃতি নয়। ছানা কিন্তু ফোটানো দুধের কৃত্রিম বিকৃতি। বাঙালি দুধের মধ্যে অন্য-দ্রব্য সংযোগ করে দুধ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, যাতে সারবস্তু ও জলীয় অংশ পৃথক হয়ে যায়। এইভাবে দুধ ছিন্নভিন্ন করা হয় বলেই বলা হয় ছানা। সংস্কৃত ভাষায় ছানার কোনরকম উল্লেখ নেই এবং অন্য ভাষাতেও নেই। ফলত ছেনা বা ছানা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত বিকাশ এবং বাংলা ভাষায় এই শব্দটির আগমন ছিল অজ্ঞতি। ফলে সঙ্গত কারণেই হিন্দু শাস্ত্রে দেবদেবীর পুজোয় ছানা থেকে প্রস্তুত মিষ্টির প্রচলন ছিল না। বৈদিক যুগে দুধ ও দুধ থেকে তৈরি ঘি, দধি, মাখন ইত্যাদি ছিল দেবখাদ্য। মহাভারতেও দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় খাদ্য ছিল ননী এবং মাখন। এজন্য দুধ থেকে রূপান্তরিত প্রায় সব খাদ্যি দেবখাদ্য বলে বিবেচিত হত।
কনফেকশনারির ইতিহাস নিয়ে আমেরিকার ‘ডেলি মীরর’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে গবেষক টিম রিচার্ডসন মিষ্টির ইতিহাসে এক সময়ক্রম তুলে ধরেন। তাঁর মতে খ্রিষ্টপূর্বে আট হাজার অব্দে যখন পৃথিবী জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গুহামানবরা, তখনই মিষ্টির স্বাদের সঙ্গে পরিচয় হয় মানুষের। তবে ঘটনাটি ভারতবর্ষে নয়, ঘটনাটি ভ্যালেন্সিয়াতে ঘটে। সেখানকার গুহাচিত্র গবেষনা করে দেখা গেছে ওই সময়কার মানুষেরা সর্বপ্রথম খুজে পান যে, মৌচাকের ভিতরে থাকা মধু আসলে এক অমৃতবস্তু, যা স্বাদে মিষ্টি এবং প্রাকৃতিক ভাবেই পাওয়া যায়। তৈরি করা মিষ্টি পৃথিবীকে সম্ভবতঃ ভারতবর্ষই প্রথম চিনিয়েছে। ‘সুগার’ শব্দটির উৎপত্তি হয় সংস্কৃত শব্দ ‘শর্করা থেকে এবং ‘ক্যান্ডি’ শব্দটি ও এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘খান্দা’ থেকে। শর্করা হল পরিশোধিত চিনি আর খান্দা হল অপরিশোধিত চিনি। পৃথিবীকে এই চিনির পরিশোধনও যতদূর সম্ভব ভারতীয়রাই শিখিয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ছয়হাজার অব্দে ত্রোঞ্জযুগে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর লোকেরা এই কাজটি করতে পারতেন বলে অনুমান করা হয়। পরবর্তীকালে একাধিক প্রমান মিলেছে যে খ্রিষ্টপূর্বে ৫০০ অব্দ থেকে ৩০০ অব্দে ভারতবর্ষে চিনি পরিশোধিত হতে শুরু করে। এরও বেশ কিছুকাল পরে আসে ভারতবর্ষে প্রথম মিষ্টি মোতিচূড়ের লাড্ডু তখন ও দুধ বা ছানা মিষ্টির জগতে প্রবেশ করেনি। এই সময়কার আদি সংস্কৃত সাহিত্যে মিষ্টির পরিবর্তে ‘মিঠাস’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, যা পরবর্তী কালে মিঠাই তে পরিবর্তিত হয় এবং সময়ের সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তা মিষ্টিতে এসে ঠেকেছে। পরবর্তীকালে সংস্কৃত আদি সাহিত্যে বহু মিষ্টির হদিস পাওয়া যায়, যার বেশির ভাগই হারিয়ে গেছে এবং অল্প কিছু সংখ্যক অবিকৃত অবস্থায় আছে। এরপর পনেরো এবং ষোড়শ শতকে ভারতে বৈদিশিক আক্রমনের হাত ধরেই একের পর এক মিষ্টির আগমন ঘটতে শুরু করে। ওই সময় বাংলায় চৈতন্য দেবের আমলে রস কদম্বের সৃষ্টি হয় যা বাংলার অন্যতম প্রাচীর একটি মিষ্টি। ওই সময়কার বাংলা সাহিত্যের নিদর্সন যেমন বৈজ্ঞব পদাবলীতেও একাধিক মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলার মিষ্টিকে সুকুমার সেন দুভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগটি হল একক উপদানে তৈরি মিষ্টি, এ ধরনের মিষ্টিতে চিনি বা গুড়ের সাথে আর কিছু মিশ্রিত থাকে না। যেমন গুড় বা চিনির নাড়ু, চাকতি, পাটালি খাঁজা, ছাঁচ ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধরনের মিষ্টিকে তিনি দুটি ভাগে ভাগ করেছেন । প্রথমভাগে গুড় বা চিনির তৈরি মিষ্টি যেমন নারকেল, তিল, নাড়ু, বাদাম বা তিলের খাঁজা, চিড়ে মুরি ও খইয়ের মোয়া। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে দুগ্ধজাত দ্রব্য সহযোগে চিনি বা গুড় দিয়ে নির্মিত বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি এর মধ্যে পড়ে রসগোল্লা, সন্দেশ, মন্ডা ইত্যাদি।
বাঙালির কিছু উৎসব রয়েছে যা একেবারেই মিষ্টি ছাড়া অসম্পূর্ণ, তার মধ্যে উল্লেখ্য হল বাংলা নববর্ষের শুরুতে হালখাতা, দুর্গা পুজোর বিজয়া, অগ্রহায়ণে নবান্ন, শীতে পৌষ পার্বন, কোথাও ছানার মিষ্টি নেই। জন্মাষ্টমীতে তালের বড়া, পৌষ পার্বনে একাধিক পিঠে তৈরি করে হাতের কেরামতিতে বাংলার বউ-মেয়েরা পরিবারের সকলের মন জয় করত। কিন্তু সেই পিঠেও আর নেই! ব্যস্ত বাঙালি পিঠে তৈরি ভুলে গিয়েছে। পিঠে খাওয়ার জন্য অনেকটাই মিষ্টির দোকানের পাটিসাপটা, মেলা বা সরকার কর্তৃক আয়োজিত পিঠে পুলি উৎসবই ভরসা। প্রথম দিকে বাংলায় চিনি থেকে ভোজ এবং ভোগ দুই প্রকারেরই মিষ্টি তৈরি হত। এই তালিকায় ছিল বাতাসা, নকুলদানা এবং কদমা। এই নকুলদানা পূর্বে যখন তৈরি করা হত, তখন তার মধ্যে একটি মাত্র ছোলা দেওয়া হত, কিন্তু বর্তমান নকুলদানা কেবলমাত্র একটি চিনির ডেলা, ছোলাটি পথ হারিয়েছে। বাতাসার ক্ষেত্রে চিনির সাদা এবং গুড়ের লাল দুটি প্রকার দেখা যেত। বলা হত অতিথি নারায়ণ, তাই ক্লান্ত পথিক অথবা অথিতি এবং অন্য কেউ বাড়িতে এলে তাকে জল এবং বাতাসা সহযোগে স্বাগত জানানোর একটি রেওয়াজ এই বাংলার প্রচলিত ছিল। কিন্তু অথিতি বরণের এই রীতিটিও লুপ্ত হয়েছে। কদমা এখন ঈশ্বরের নৈবেদ্যেই স্থান পেয়েছে। শ্বেতশুভ্র বর্নের গোলাকার আকৃতি বিশিষ্ট চিনি নির্মিত কদমার ভিতরটি ছিল ফাঁপা, উপরের এবং নীচের অংশটি ছিল একটু চাপা। বর্ধমানের মানকরের কদমা যথেষ্ট প্রসিদ্ধ ছিল। এছাড়াও পুজোর ক্ষেত্রে চিনি দিয়ে নির্মিত বিভিন্ন আকৃতির জন্তু-জানোয়ার, জিনিসপত্র ইত্যাদি পাওয়া যায়; সেগুলিকে একত্রে খেলনা বলা হয়।
চিনি থেকে তৈরি শঙ্কুর মতো সূচালো মোদক দেখা যায়, যা ছাড়া কালীপূজো অসম্পূর্ন। আবার মহারাষ্ট্রে গনেশপুজোয় অন্য একপ্রকারের মোদক দেখা যায় যা আকার আকৃতিতে অনেক ছোট এবং যা নারকেল, চালের গুঁড়ো, ময়দা, খোয়াক্ষীর ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়। নীহাররঞ্জন রায়ের লেখাতে কোন রকম ছানার মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায় না, যা বলে দেয় প্রাচীন বাংলাওয়াই মিষ্টিতে ছানা ছিল পরিত্যাজ্য। তিনি লিখেছেন, ‘কোজাগড় পূর্নিমারাত্রে আত্মীয় বান্ধব্দের চিপিটক (চিড়া) এবং নারকেলের প্রস্তুত নানা প্রকারের সন্দেশ পরিতৃপ্ত করিতে হইত এবং সমস্ত রাত বিনিদ্র কাটিত পাসা খেলায়’।
প্রাচীন নথি থেকে আরও মিষ্টির কথা পাওয়া যায়। যেমন, ময়দা ও চিনির সিরায় তৈরি গোলামু। বিয়েবাড়িতে আগে ভিয়েন বসানোর রেওয়াজ ছিল। এই ভিয়েন ঘরের গন্ধে খানিক বসে থাকলেও বাঙালির মন ভাল হয়ে যেত। এই ভিয়েন কথাটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘হবন’ থেকে। বিশাল একখানি নৌকাসম কড়াইতে দাঁড়ের মতো খুন্তি দিয়ে তৈরি করা হত ফরমায়েশি মিষ্টি যা নিমন্ত্রিত অতিথিদের পাতে পড়ত। এই ভিয়েন এখন স্থান পেয়েছে বাঙালিরে স্মৃতিতে, যদিও কলকাতার কিছু বনেদি বাড়ির পুজোয়, যেমন শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোতে এখনও ভিয়েন বসানো হয় এবং পুজোর চারদিন সেই ভিয়েনেই মায়ের ভোগ হিসেবে দরবেশ, জিলেপি, গজা, পান্তুয়া এবং খাঁজা প্রস্তুত করা হয়। ছানা আবিষ্কারের পর থেকে গত দু’শো বছরে বাংলার মিষ্টির বিপ্লব ঘটে গেছে। বাঙালি তার রসনার পরিতৃপ্তির জন্য মিষ্টির তালিকাটি ক্রমশঃ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে চলেছে। প্রত্যেকদিনি নিত্যনতুন সংযোজন ঘটছে। আবার কিছু বিয়োজনও ঘটছে । যেমন গ্রামবাংলার হাওয়াই মিঠাই বা বুড়ির সুতো যার সাথে ছেলেবেলায় সুখস্মৃতি জড়িয়ে। অসম লড়াইয়ে হাওয়াই মিঠাইযালারা আজ অবলুপ্তের পথে। যদিও এর আধুনিক সংস্করণ মেশিনে প্রস্তুত কটনক্যান্ডির দেখা মেলে মেলায়, উৎসবে, পার্বনে। গ্রাম বা মফঃস্বলের অনেকেই একটি চেনা দৃশ্য ছিল, একজন লোক তার হাতে লম্বা মোটা একটি লাঠি আর মধ্যে একতাল ঘন চটচটে চিনির সিরা, দুপুর বেলায় এদের দেখা মিলত এবং বাচ্চাদের ফরমাস মতো খলনা, পুতুল প্রস্তুত করে দিতেন। সেই খলনা মিঠাইওয়ালারা বিশ্বায়নের চাপে বিদায় নিয়েছে। রবিঠাকুরের অমলের দইওয়ালারা বা মিনির প্রিয় কাবুলিয়ালাদের আর চোখে পড়ে না বাঙালির। মিষ্টি প্রিয় বাঙালি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ভুলে ফিউশনে মজেছে।