শেষ জীবন কেমন ছিল দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির?
গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরের কারণে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি প্রয়াত ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের কি হাল হয়েছিল, তা অনেকেরই হয়তো জানা নেই। এই মন্দিরের জন্য বড় মূল্য চোকাতে ডঃ প্রসাদ’কে এর জন্যে বিরাট মূল্য চোকাতে হয়।
জওহরলাল যে সোমনাথ মন্দিরের বিপক্ষে ছিলেন, – কথাটা কমবেশি সকলেরই প্রায় জানাই ছিল। অতএব সর্দার প্যাটেল গান্ধীজীর শরণাপন্ন হলেন। কোন মতে সেখান থেকে সম্মতি আদায় করেই তিনি হাত লাগালেন মন্দিরের পুনঃনির্মানে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! কাজ শেষ হবার আগেই মৃত্যু হল তাঁর।
সর্দার’জীর মৃত্যুর পর, তাঁর এই অসমাপ্ত কাজের ভার গিয়ে পড়ে, শ্রদ্ধেয় শ্রী কে এম মুন্সীর উপর, অন্যদিকে যিনি আবার ছিলেন নেহেরুর ক্যাবিনেট মন্ত্রীও বটে! ইতিমধ্যে মৃত্যু হয়েছে গান্ধীজীর-ও।
গান্ধী-প্যাটেলের মৃত্যুর পর এই ইস্যুতে নেহেরুর বল্গাহীন বিরোধী সুর ক্রমশই তীব্রতর হতে শুরু করে। চড়তে থাকে তিক্ততার পারদ। তেমনই একটি মিটিং-এ তো একবার মুন্সীকে কড়া ধমকই দিয়ে বসেন নেহেরু! তাঁর বিরুদ্ধে ‘হিন্দু-পুনরুত্থানবাদ’ তথা ‘হিন্দুত্ববাদ’ প্রচারের তকমা লাগিয়ে তীব্র ভর্ৎসনাও করেন তিনি। কিন্তু মুন্সীজীও তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। তাঁর চাঁছা-ছোলা বক্তব্য – সর্দার প্যাটেলের অসমাপ্ত কাজ তিনি সমাধা করবেন! তাছাড়া মুন্সী ছিলেন নিজেও একজন গুজরাটি, অতএব তাঁর পক্ষে এই বিষয়টিও মন্দির নির্মানে গতি আনতে সহায়তা করে।
অতঃপর মন্দির নির্মান সমাপ্ত হলে, তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদকে শুভ-দ্বারোদঘাটনের জন্য সসম্মানে আমন্ত্রণ জানান। রাজেন্দ্রপ্রসাদও অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে উক্ত ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকতে স্বীকৃত হন। কিন্তু এই খবরে বেঁকে বসেন নেহেরু। জল এতদূর গড়ায় যে, স্বয়ং নেহেরু চিঠি লিখে ডঃ প্রসাদকে সোমনাথ মন্দিরের উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে নিষেধ করে দেন। কিন্তু এবারে রুখে দাঁড়ালেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। নেহেরুর রক্তচক্ষু’কে আমল না দিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন সোমনাথ মন্দিরে। শুধু উপস্থিত হওয়াই নয়, সেখানে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে দিলেন এক জবরদস্ত ভাষণ।
মারাত্মক ঝটকা খেলেন নেহেরু। তাঁর আঁতে লাগল ঘা! এটিকে তিনি নিজের নৈতিক পরাজয় বলে হজম করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু বিনিময়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদকেও বড়ো গুনাগার গুনতে হল, কারণ এরপর থেকে নেহেরু তাঁর সঙ্গে যে ধরনের নজিরবিহীন অভব্য আচরণ শুরু করেন, তা ভাবলে আজও বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়!
সোমনাথ মন্দিরের তরজা’কে কেন্দ্র করে রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও নেহেরুর ব্যক্তিগত সম্পর্কে এতটাই তিক্ততার সৃষ্টি হয় যে, রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর তাঁকে দিল্লীতে থাকার মত একটি ঘর পর্যন্ত বরাদ্দ করতে অস্বীকার করেন নেহেরু। অথচ রাজেন্দ্রবাবু লেখালেখি পছন্দ করতেন, তার বড় শখ ছিল, বৃদ্ধ বয়সে জীবনের শেষ দিনগুলি তিনি দিল্লীর বুকেই বই-টই লিখে কাটান। নেহেরুর মত মানুষের কি এমন’টা করা উচিৎ ছিল? একজন ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতির যা যা সম্মান বা অধিকার পাবার কথা ছিল, তার সব কিছু থেকেই ওই ভদ্রলোকটিকে বঞ্চিত করা হয়।
অগত্যা নিরুপায় প্রসাদজী তাঁর আদি নিবাস পাটনায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু সেখানেও তাঁর নিজস্ব কোনও সংস্থান ছিল না। না ছিল টাকা-কড়ি, না কোন বাড়ি-ঘর। আর অন্যদিকে পাটনা’তে যথেষ্ট সংখ্যক সরকারী বাংলো বা আবাসন থাকা সত্ত্বেও নেহেরুর নিষ্ঠুরতায় সে সব জায়গায় তাঁর থাকা খাওয়ার নুন্যতম সুযোগ-ও তিনি হারালেন।
শেষমেশ পাটনার সদাকৎ আশ্রমের একটি আলো-বাতাসহীন বদ্ধ কুঠুরিতে ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলে। না, তাঁকে দেখভাল করার মতও কেউ ছিল না; ছিল না কোন ডাক্তার!
ধীরে ধীরে শরীর ভেঙে পড়তে লাগল, ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতির। আবদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে ক্রমশঃ দেখা দিল শ্বাসকষ্ট। সারা দিন ধরে দমকে দমকে কাশির সঙ্গে উঠতে লাগল কফ। কিন্তু হায়! তিনি ছিলেন অসহায়!! দেশের একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুবাদে দ্বারে দ্বারে সাহায্যের জন্য ভিক্ষা করাও যে তাঁর পক্ষে ছিল অসম্ভব।
অন্যদিকে, রাজেন্দ্রপ্রসাদের পাটনা আসার পর থেকে তিনি কেমন আছেন, বা তাঁর কি ভাবে চলছে? – ইতিহাস সাক্ষী, চক্ষুলজ্জার খাতিরে নেহেরু একবারও সে খবর নেবার প্রয়োজন বোধ করে দেখলেন না। শুধু নেহেরুই নন, সেদিন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি’র অসুস্থতার খবর পাবার পরও এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, যিনি নূন্যতম চিকিৎসার সুবিধাও তাঁর কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছিলেন!
বিহারে তখন কংগ্রেসেরই রাজত্ব, সুতরাং বলাইবাহুল্য কোনও এক অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ডঃ রাজেন্দ্রবাবু সুচিকিৎসা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে চিরবঞ্চিত রইলেন। পাশাপাশি ইতিহাস সাক্ষী হয়ে রইল তাঁর প্রতি নানা নির্দয় অমানবিক আচরণের। কার নির্দেশে এসব ঘটেছিল সেদিন?
ডঃ প্রসাদের কফ-কাশির সমস্যা ছিল। তাই প্রায়ই পাটনার মেডিক্যেল কলেজে তিনি চিকিৎসা করাতে যেতেন। সেখানে, আর দশজন সাধারণ রোগীর মতোই তাঁর চিকিৎসা হত। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন,… সেখানে যে মেশিনটি’তে তাঁর চিকিৎসা হত, সেটিকেও পর্যন্ত দিল্লী পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে জানা যায়। অর্থাৎ রাজেন্দ্রবাবুকে প্রকারান্তরে তিলে তিলে মারার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত ভাবেই সম্পন্ন করা হয়েছিল।
একবার শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে সদাকৎ আশ্রমে গিয়ে পৌঁছান। উদ্দেশ্য, দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি তথা সংবিধান সভার অধ্যক্ষ কেমন আছেন তা স্বচক্ষে পরিদর্শন করা। কিন্তু হায়! এ কি দেখছেন নারায়ণ? রাজেন্দ্রপ্রসাদের অবস্থা দেখে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান! তাঁর চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। তাঁর ভাবনাতেই আসে না, কি বলবেন তিনি? আর একমূহুর্তও অপেক্ষা না করে তিনি তাঁর অফিসারদের নির্দেশ দেন, প্রসাদজীর কামরাখানিকে যাতে অবিলম্বে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা হয়। সেই মত কাজও হয় তুরন্ত। কিন্তু রাজেন্দ্রবাবু আর বেশি দিন বাঁচেননি। সেই ঘরেই ১৯৬৩-র ২৮শে ফেব্রুয়ারী তাঁর দেহান্ত হয়।
ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের মৃত্যুর পরেও নেহেরুর ক্ষোভ প্রশমিত হয় নি। শান্ত হতে পারেননি তিনি। তাই প্রসাদজী-র অন্ত্যেষ্টি-তে পর্যন্ত যোগ দিতে নেহেরু অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। আর সম্ভবত সেই কারনেই, রাজেন্দ্রপ্রসাদের শেষ যাত্রার দিন তিনি পাটনা থেকে বহু দূরে রাজস্থানে-র জয়পুরে চলে যান। শুধু কি তাই? রাজস্থানের তৎকালীন রাজ্যপাল, ডঃ সম্পূর্ণানন্দজী এই উপলক্ষে পাটনা আসতে চাইলে স্বয়ং নেহেরু তাঁকে সেখানে যেতে বারণ করেন!
“এটা কি ভাবে সম্ভব? যে, দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন কোনও রাজ্যে অবস্থান করছেন; আর সে রাজ্যের রাজ্যপালই অনুপস্থিত”! – দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির অন্তিম যাত্রায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সে দেশেরই কোনও এক অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের কাছে সেদিন নেহেরুর তরফে এমনই বার্তা প্রেরিত হয়েছিল। অতএব এরপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও সম্পূর্ণানন্দজীকে তাঁর পাটনা সফর বাতিল করতে হয়।
এখানেই শেষ না। নেহেরু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, তথা বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের উত্তরসুরী ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণকেও একই কারণে পাটনা সফর বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ডঃ রাধাকৃষ্ণণ সে কথায় কর্ণপাত না করে সোজা রাজেন্দ্রপ্রসাদের অন্ত্যেষ্টিস্থলে পৌঁছে দেশের মানরক্ষা করেন।