বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

জানেন কী, ফাল্গুন সংক্রান্তিতে ঘেঁটু ঠাকুরের পুজো কেন করা হয়?

March 10, 2023 | 2 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ফাল্গুন সংক্রান্তির দিন সকালবেলায় ঘন্টাকর্ণ বা ঘেঁটু ঠাকুরের বার্ষিক পূজার দিন।

“ঘন্টাকর্ণ মহাবীর সর্বব্যাধি বিনাশন
বিস্ফোটক ভয়ে প্রাপ্তে রক্ষ রক্ষ মহাবলঃ”।

ঘন্টাকর্ণ ঠাকুর গ্রামবাংলায় লোকমুখে ‘ঘেঁটু’ ঠাকুর নাম পরিচিত। তিনি স্বয়ং মহাদেবের অনুচর। পুরাণ মতে, লৌকিক এ দেবতা দেবকুমার থাকা অবস্থায় করে বসেন কোনও বড়সড় অপরাধ। তাই বিষ্ণু তাকে অভিশাপ দেন তাঁকে। ফলে পিশাচ কুলে তাঁকে জন্ম নিতে হয় । তার নাম ঘণ্টাকর্ণ হয় কারণ তাঁর দুই কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখা যাতে কোনোভাবেই যেন বিষ্ণুনাম কানে না আসে।

ঘেঁটু ‘খোস-পাঁজরা’ নামের চুলকানির অসুখের লৌকিক দেবতা। এর পূজা করলে ‘খোস-পাঁজরা’ হয় না। এই পূজার ফুলই হল ‘ঘেঁটু ফুল’। ঘেঁটু ফুল ফাল্গুন মাসের শুরু থেকেই ফুটতে শুরু করে। সাদা রঙের এই ফুলের ভিতরটা গাঢ় গোলাপী। সাদা সাদা শুঁড় বেরিয়ে থাকে। শুঁড়ের পিছন দিকটাও গাঢ় গোলাপী। এই ফুল অবশ্য শুধু গ্রাম বাংলা নয় শহরের রাস্তার ধারেও ফুটতে দেখা যায়।

প্রতি বছর ফাল্গুনের সংক্রান্তির সকালে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কোনো মন্দিরে ঘেঁটু ঠাকুরের পূজা হয় না। পূজা হয় জলাশয়ের পাশে রাস্তার মোড়ে। এই পূজার জন্য আলাদা করে পুরোহিতের দরকার হয় না, গৃহস্থ পুরুষ-মহিলারাই করতে পারে। পূজার জন্যে লাগে মুড়িভাজার পুরোনো ঝুলকালিমাখা একটি মাটির খোলা (‘কেলে হাড়ি’), তেল হলুদে চোবানো ছোট বস্ত্রখণ্ড, তিনটি কড়ি, ছোট ছোট তিনটি গোবর দিয়ে পাকানো পিণ্ড, ঘেঁটু ফুল, সিঁদুর, ধান ও দূর্বা ঘাস। মাটির খোলাটা নিকোনো জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়। তার উপরে তিনটি গোবরের পিণ্ড লাগিয়ে সেগুলি কড়ি, সিঁদুর ঘেঁটু ফুল দিয়ে সাজানো হয়। খোলার উপরে বস্ত্রখণ্ডটি বিছিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ির সামনে উঠোনে বা একটু দূরে রাস্তার তিনমাথা, চারমাথার ধারে জনতার মাঝে এটি সম্পন্ন হয়। ছড়া কাটা হয় —

“ধামা বাজা তোরা কুলো বাজা
এলো এলো দ্বারে ঘেঁটু রাজা।”
পূজার শেষে অল্পবয়সী ছেলেরা মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে খোলাটা ভেঙে দিয়ে তারপর দৌড়ে পুকুরের জলে হাত পা ধুয়ে আসে যাতে তাদের চর্মরোগ না হয়। এরপর মহিলারা ওই বস্ত্রখণ্ডটি এনে বাচ্ছাদের চোখে বুলিয়ে দেন এবং খোলার ঝুলকালি কাজলের মতো পরিয়ে দেন যাতে চোখ ভালো থাকে।

এই ঘেঁটু ঠাকুরকে বিদায় করে হরিনাম কীর্তন বা হরিযশ গাওয়া হয় —
“ভাগ্যমানে কাটায় পুকুর চণ্ডালে কাটে মাটি
কুমোরের কলসী, কাঁসারির ঘটি
জল শুদ্ধ, স্থল শুদ্ধ, শুদ্ধ মহামায়া
হরিনাম করলে পরে শুদ্ধ হয় আপন কায়া॥”

আজকের এই দিনে গ্রাম বাংলার ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা কলার পাতা দিয়ে পালকি তৈরী করে পালকির ভিতরে প্রদীপ জালিয়ে এবং পালকিটিকে ঘেঁটু ফুল দিয়ে সাজিয়ে ঘেঁটু ঠাকুরের পুজো করেন। সন্ধ্যেবেলা ছোট ছোট ছেলেরা রঙীন কাগজ ও কঞ্চি দিয়ে ছোট্ট ডুলি বানিয়ে তাতে ঘেঁটু ফুল ও প্রদীপ দিয়ে ঘেঁটু ঠাকুরকে সাজিয়ে তা কাঁধে করে বাড়ি বাড়ি ঘোরে এবং ঘেঁটুর গান গেয়ে চাল পয়সা ভিক্ষা করে।
১) শোন শোন সর্বজন ঘাঁটুর জন্ম বিবরণ।

পিশাচ কুলে জন্মিলেন শাস্ত্রে লিখন।
বিষ্ণুনাম কোনমতে করবে না শ্রবণ
তাই দুই কানে দুই ঘন্টা করেছে বন্ধন।

২) ঘেঁটু যায় ঘেঁটু যায় গৃহস্থের বাড়ি
এক কাঠা চাল দাও কুমড়োর বড়ি
যে দেবে থালা থালা তার হবে কোঠা-বালা
যে দেবে মুঠো মুঠো তার হবে হাত ঠুটো
যে দেবে এক পলা তেল তার হবে সোনার দেল।

৩) আলোর মালা চাল-ডাল দাও
নয় খোসপচড়া লও।
যে দেবে ধামা ধামা
তারে ঘাঁটু দেবে জরির জামা
যে দেবে শুধু বকুনি।
ঘাঁটু দেবে তাকে খোস-চুলকানি।

(তথ্য সূত্র: লৌকিক দেবদেবী এবং বাংলার লোকসংস্কৃতি, দ্বিতীয় খন্ড এবং অন্যান্য বই)

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Falgun Sankranti, #Ghetu thakur, #Ghetu pujo

আরো দেখুন