সন্দীপ দত্ত: লিটিল ম্যাগাজিন আন্দোলনের এক বনস্পতি
সৌভিক রাজ
নাটু নাটু অস্কার জিতছে, হিরোর ঘুষি খেয়ে দশ হাত দূরে ছিটকে পড়ছেন প্রতিনায়ক, শপিং মলের ছাড়, ইউটিউবে গন্ধরাজ মোমোর ভিডিওয় ব্যস্ত বাঙালির বইমেলা বলে একটা উৎসব আছে। পিঠে পুলি, ফিশফ্রাই পেরিয়ে বই কেনাকাটা আছে। বাঙালি জাতটা আছে বলেই কোয়ার্টিতে এখনও ছন্দের জন্ম হয়। জাতটা বেওসা না, আজও ‘মম চিত্তে’র’ মাদকতায় মাতে। আঠারোর তরুণ স্বপ্ন দেখে পূর্ণ সময়ের লেখক হওয়ার। কিন্তু তরুণের স্বপ্নের স্পর্ধা কে? বলা ভাল, কী? উত্তর লিটিল ম্যাগাজিন। আর সেই লিটিল ম্যাগাজিনকে বুকে করে আগলে রাখা মানুষটি কাল হারিয়ে গেলেন। বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভেলিয়নে দেখা যেত তাঁকে।
‘লিটল ম্যাগাজিন কিনুন, লিটল ম্যাগাজিন পড়ুন’ স্লোগানে সাজানো টুপি পরে মানুষটি বইমেলায় ঘুরতে এককালে। আদপে মানুষটা মশাল, বাংলার লিখিয়ে তৈরির আখড়ার পালোয়ান। ‘লেখা ছাড়া কাজ কি করিস?’-এর উত্তর না দিতে পারা তরুণদের আশ্রয়ের নাম সন্দীপ দত্ত। লিটল ম্যাগাজিন অভিভাবক তিনি। লিটল ম্যাগাজিন চর্চা, লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণে গোটা জীবন লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি। মির্জাপুরের সিটি স্কুলের শিক্ষক সন্দীপ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ছাত্র।
১৯৫১ সাল, বইপাড়ার ১৮এম টেমার লেনে জন্ম সন্দীপ দত্তর, বইপাড়ায় জন্মকে নিজের জীবন দিয়ে সার্থক করে গিয়েছেন তিনি। লিটিল ম্যাগাজিন সংগ্রহের নেশা ধরেছিল ছোটবেলা থেকেই। আঞ্চলিক ইতিহাস তাঁকে আকর্ষণ করত। ১৯৭০ সাল কলেজে পড়ুয়া সন্দীপ শুরু করলেন লিটিল ম্যাগাজিন, সম্পাদনা নিজেই করতেন। নাম পত্রপুট। ঘুরে বেড়াতেন প্রাচীন পত্রিকা সংগ্রহের জন্য। এরই মধ্যে ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা। যা ঠেসে বারুদ ভরে দিল মশালে। ন্যাশনাল লাইব্রেরির মেঝেতে পড়ে রয়েছে অজস্র লিটল ম্যাগাজিন। বয়সে সেগুলো বেশ প্রবীণ। সাহিত্য পিপাসুর কাছে যা রত্ন ভাণ্ডার; শুরু হল লড়াই। সেদিন থেকেই তিনি আশ্রয়দাতা। অপ্রয়োজনীয় বলে দাগিয়ে দিয়ে যাদের ফেলে দেয় বিশ্বায়ণের দিকে হেলে পড়া দুনিয়ায়, তাদের ছায়া দিতে শুরু করলেন সন্দীপ।
১৯৭২ সালের ২৭-৩০ সেপ্টেম্বর এক প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন তিনি, প্রতিবাদ বলাই শ্রেয়। ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে লিটল ম্যাগাজিন সরিয়ে ফেলার প্রতিবাদে নিজের বাড়িতেই আয়োজন করেছিলেন প্রদর্শনীর। ফেলে দেওয়া পত্রিকা যা ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে আনতেন, তা দিয়েই প্রদর্শনী। আস্তে আস্তে তৈরি হতে থাকল মঞ্চ, ঠিক খড় বেঁধে মাটির প্রলেপ দেওয়ার মতো। ১৯৭৮ নাগাদ পৈতৃক বাড়ির একতলার বৈঠকখানায় তৈরি হল গ্রন্থাগার। কেবল লিটিল ম্যাগাজিনরা থাকবেন সেখানে। হাল আমলের লেখকদের কাছে সিধু জ্যাঠার বাড়ি হয়ে উঠেছিল বাড়িটি। ৬৫০ পত্রিকা সম্বল করেই কলকাতার এই প্রথম লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহশালা, ‘লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি বাংলা সাময়িকপত্র পাঠাগার ও গবেষণাকেন্দ্র’ পথ চলা শুরু হয়েছিল। ১৯৭৯ সাল থেকে গ্রন্থাগারের সদস্যপদ দেওয়া শুরু হয়। বর্তমানে এই গ্রন্থাগারের প্রায় ১৫০ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। নয়ের দশকে যা কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র নামে পরিচিতি পেয়েছিল। বাংলা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের অন্যতম ধারক, তিনি। লিটল ম্যাগাজিনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন তিনি।
৭২ বছরে চলে গেলেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। গ্যাংগ্রিনের কারণে একটি পা বাদ দিতে হয়েছিল। এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর ডায়ালিসিস চলছিল। বইমেলায় আনন্দর স্টলে ভিড় ঠেলে বই কিনে বেরিয়ে, যে পাঠক লিটিল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়ন পাশ কাটিয়ে চলে যান; তারা হয়ত সন্দীপ দত্তকে উপলব্ধি করতে পারবেন না। কিন্তু লিখতে আসা তরুণদের কাছে তুলসী মঞ্চের সন্ধ্যা প্রদীপ হয়ে থাকবে সন্দীপ দত্তর স্মৃতি।