বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

বৌবাজারের ফিরিঙ্গি কালী বাড়ি কি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির নামে? জানুন ইতিহাস

March 24, 2023 | 4 min read

বৌবাজারের ফিরিঙ্গি কালী বাড়ি, নিজস্ব চিত্র

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বৌবাজার মোড়ে ব্যস্ত রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে ফিরিঙ্গি কালী বাড়ি। লোককথা থেকে রূপোলী পর্দায় বার বার উঠে এসেছে এই মন্দিরের কথা। কথিত আছে এই মন্দিরে বসে গান গাইতেন অ্যান্টনি কবিয়াল। ভিনদেশি ভক্ত কবিয়ালের নামেই পরিচিত পেয়েছে মন্দির। যদিও অনেকে বলেন, ফিরিঙ্গি পাড়ার কাছাকাছি হওয়াতেই নাম হয়েছে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি। সারা ভারত জুড়ে চলছে ভক্তি আন্দোলনের জোয়ার। মা কালী তখন স্থাপিত শ্মশানে। তখন তিনি শ্মশান কালী রূপে পরিচিতা। মূলত সেই সময় গঙ্গা বয়ে চলত আজকের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের উপর দিয়ে। এই গঙ্গার পাশেই গা ছমছমে গভীর অরণ্য। একসময় দিনের বেলায় মানুষ ও যেতে ভীষণ ভয় পেত। সেই অরন্যের মধ্যেই এক মহাশ্মশান। মহাশ্মশানে একটি ছোট্ট চালা ঘর। সেই চালাঘরে শিবলিঙ্গের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন দেবী কালিকা। শ্মশানকালী হলেও দেবীর নাম কিন্তু সিদ্ধেশ্বরী।

কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গোড়াপত্তন হল কলকাতা নগরীর। নির্জনতা কমতে লাগল। যানবাহন চলাচলও হতে লাগল। আর তার মধ্যে গড়ে উঠল বসতি। আর যার ফলে বাড়তে লাগল ফিরিঙ্গিদের বসবাস। আর এখানেই আবির্ভাব ঘটল হেন্সম্যান অ্যান্টনির, তিনি খ্রিস্টধর্মাবলম্বী। আর বাঙালির অ্যান্টনি কবিয়ালের। তিনি জাতিতে পর্তুগিজ ছিলেন কিন্তু তিনি প্রায়ই আসতেন শ্মশানের চালাঘরে।
এই মন্দিরে বসে গান গাইতেন অ্যান্টনি কবিয়াল। ভিনদেশি ভক্ত কবিয়ালের নামে পরিচিত পেয়েছে এই মন্দির। তাই শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির বা ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি হল কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রাচীন কালী মন্দির। আজ যা বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিটে অবস্থিত। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মন্দিরটি ৫০০ বছরের পুরনো। পর্তুগিজ বংশভূত কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি মা কালীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে এই মন্দিরে আসতেন। সেই থেকেই এই মন্দিরের পরিচিতি ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি হিসেবে।
ধীরে ধীরে একসময় আজকের বউবাজারের কালী লোকমুখে হয়ে উঠল ফিরিঙ্গি কালী। মন্দিরের সামনে দেওয়ালের ফলোকে লেখা আছে–
“ওঁ শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মাতা ঠাকুরানী,
স্থাপিত ৯০৫ সাল
ফিরিঙ্গি কালী মন্দির”।
কালী বাড়ির ইতিহাস থেকে জানা গেছে, ১৪৩৭ সনে ভাগীরথী নদীর তীরে জঙ্গলের মধ্যে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল শিব ও কালী বিগ্রহ। মূলত মন্দিরটি প্রথমে ছিল একটি শিব মন্দির। ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির সঠিক প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে জানা যায় না।


জানা যায়, ১৮২০ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত এই মন্দিরের পূজারী ছিলেন নিঃসন্তান শ্রীমন্ত পন্ডিত। কালীমন্দির ও দেবীমূর্তি সর্বপ্রথম কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কেউই তা জানেন না। ১৮৮০ সালে শশীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ৬০ টাকার বিনিময় এই দেবোত্তর সম্পত্তি হাতে পান। সেই থেকে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার এখনও এই ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির সেবায়েত।
ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি একটি চাঁদনি স্থাপত্যের মন্দির। এই মন্দিরের কালী মূর্তিটি মাটির তৈরি। বিগ্রহটি উচ্চতা প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট। বিগ্রহটি সবসনা। ত্রিনয়নী সুদর্শনা। মন্দির সংলগ্ন শিবের মন্দিরটি আটচালা। কালীমূর্তি ছাড়াও মন্দিরে আছে শীতলা, মনসা, দুর্গা, শিব ও নারায়ণ এর মূর্তি। মন্দিরে প্রতি অমাবস্যায় কালী পূজা ও প্রতি পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ পূজা হয়।


অনাড়ম্বর মন্দিরটি আজও দাঁড়িয়ে আছে ২৪৪, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট, ৭০০০১২। ‘কলকাতার মন্দির মসজিদ’ গ্রন্থে গবেষক তারাপদ সাঁতরা এই মন্দির প্রসঙ্গে লিখেছেন,” অনুরূপ বৌবাজার স্ট্রিটের ফিরিঙ্গি কালীর মন্দির অংশটি যে আসলে একটি সাবেক গম্বুজ যুক্ত ছাদ দ্বারা নির্মিত আটচালা শিব মন্দিরের সঙ্গে অর্বাচীন একটি দালান সংযোগের ফসল, ভালোভাবে নিরীক্ষণ না করলে সে কথাও আর বোঝা যায় না”।

জন্মেছিলেন খ্রিস্টানের ঘরে। হিন্দু ধর্মের প্রতি আসক্ত হয়েছিলেন। নিজের ধর্ম ত্যাগ করেননি। কিন্তু বাংলা শিখেছিলেন। হিন্দু ধর্ম গ্রন্থও পাঠ করতেন। তিনি পর্তুগিজ ব্যবসায়ী হেনসম্যান অ্যান্টনি। থুড়ি অ্যান্টনি কবিয়াল। তাঁর নামই জড়িয়ে রয়েছে বউবাজারের এই কালী মন্দিরের সঙ্গে। বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের এই মন্দিরকে তাই ফিরিঙ্গি কালী বাড়ি বলেই জানেন সকলে। অ্যান্টনি নিজেকে সর্ব ধর্মের ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই মন্দিরে তাই আজও সব ধর্মের সমন্বয় ঘটে। অনেকে বলেন, বাঙালি বিধবা সৌদামিনীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করার পরই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অ্যান্টনি। সৌদামিনীই নাকি অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরাও এসে পুজো দিতেন এই জাগ্রত মন্দিরে। কিন্তু অনেকেই মানতে চান না, যে অ্যান্টনিই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের মতে, পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় আগে তৈরি হয়েছিল এই মন্দির। তখন বউবাজার এলাকা ছিল শ্মশান। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী। সেই শ্মশানে থাকতেন তন্ত্রসাধক শ্রীমন্ত পণ্ডিত। তিনিই জঙ্গলের মধ্যে শিব এবং কালী পুজো করতেন। সেই উদ্দেশ্যে তৈরি করেছিলেন এই মন্দির। সেটা ছিল আনুমানিক ১৪৩৭ সাল। আজও মন্দিরের গায়ে স্থাপনের সন হিসেবে খোদাই করা রয়েছে ৯০৫। ওই সাল বঙ্গাব্দ ধরলে পাঁচশোরও বেশি বয়স হয় মন্দিরের।

জোব চার্নক সে সময় পত্তন করেছেন কলকাতার। তখন এলাকায় বসন্ত রোগ ছড়ায়। বহু ফিরিঙ্গি আক্রান্ত হন এই রোগে। তখন তাঁরা শ্রীমন্ত পণ্ডিতের শরণাপন্ন হন। বসন্ত রোগের চিকিৎসা করিয়ে আরোগ্য লাভের পর দেবীর পুজো দিতে থাকেন। তারপরই ধীরে ধীরে লোকমুখে এই কালীর প্রচার। আর ফিরিঙ্গি সাহেবদের মুখে মুখেই প্রচার বেশি হয়েছিল বলে মন্দিরের এই নাম। পরে এখানে আসতে শুরু করেন অ্যান্টনি কবিয়াল। এক সময় মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাঁর নাম।

সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের ফলকে প্রতিষ্ঠার সাল হিসাবে উল্লেখ রয়েছে ৯০৫ বঙ্গাব্দ। তখন সেই অর্থে কলকাতা শহরে রূপান্তরিত হয়ে ওঠেনি। এই অঞ্চলে বনের মধ্যে হোগলা পাতার ছাউনিতে ছিল শিব ও শীতলার মন্দির। পরবর্তীকালে এই অঞ্চলেই গড়ে উঠেছিল ইউরোপীয়দের বসতি। আর এই মন্দিরের পাশেই ছিল চন্দননগরের অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির মামার বাড়ি। তখন মন্দিরের দেখাশোনা করতেন বিধবা প্রমীলাদেবী। তিনি মামার বাড়িত এলে এই মন্দিরে আসতেন, মন্দিরে সাধনা করতে। পরবর্তীকালে এই শিবমন্দিরেই তিনি পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করে দেবী কালীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। দেবী চতুর্ভুজা, শিবের ওপর দণ্ডায়মানা। তাঁর সারা গা স্বর্ণালংকারে সাজানো এবং উচ্চতা প্রায় সাড়ে ৮ফুট বিগ্রহ।

ফিরিঙ্গি কালীবাড়িতে দেবীর পাশেই রয়েছন অষ্টধাতুর দুর্গা, জগদ্ধাত্রীর মূর্তি, মনসা এবং নারায়ণ শিলা। আগে পশুবলি হলেও এখন আর তা হয় না। তবে চালকুমড়ো ও আখ বলি হয় ফিরিঙ্গি কালীবাড়িতে। এবছর মন্দিরের গর্ভগৃহে ভক্তদের প্রবেশাধিকার থাকে না। অমাবস্যার ভোগে থাকে খিচুড়ি, পোলাও, পাঁচ রকমের ভাজা, তরকারি, পায়েস ইত্যাদি। এইভাবে রীতিনীতি মেনেই পুজো হয় ফিরিঙ্গি কালীবাড়িতে। শোনা যায়, ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির মা রাবড়ি খেতে ভালোবাসেন। তাই কালীপুজোর ভোগে রাবড়ি দিতেই হয় মাকে। এই মন্দিরে সিদ্ধেশ্বরী কালীর পুজো হয়। এখানে অমাবস্যায় মহানিশি পুজো হয়। হয় অন্নকূট ভোগ। তবে বলির প্রথা নেই। কালী পুজোর দিন সকালে দেবীর যজ্ঞ ও পুজো সম্পন্ন হয় এবং রাত্রে অমাবস্যার মূল পুজোর সময়ও যজ্ঞ হয়। অর্থাৎ একই দিনে দুই বার যজ্ঞ হয় এই কালীবাড়িতে। এইভাবে প্রাচীন রীতিনীতি মেনে আজও পুজো হয়ে আসছে উত্তর কলকাতার ফিরিঙ্গি কালীবাড়িতে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#bowbazar, #Firingi kali mandir, #Antony Firingi, #Kali Temple

আরো দেখুন