উৎপল দত্ত ও এপিক থিয়েটার: নাটকের জীবন্ত দলিল
সৌভিক রাজ
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস এক প্রবাদপ্রতিম অভিনেতার নাম উৎপল দত্ত। খুব কম অভিনেতা আছেন, যারা একই সঙ্গে মঞ্চে এবং পর্দায় দাঁপিয়ে রাজত্ব করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম উৎপল দত্ত। এক বহুমুখী প্রতিভার মিশেল তিনি। কিন্তু নিজেকে বরাবর প্রোপাগান্ডিস্ট বলে পরিচয় দিয়ে এসেছেন উৎপল। গোলমালে তিনি অভিনয় করতে পারেন আবার আগন্তুকের ছোটমামা মণিমোহন মিত্রের চরিত্রেও তিনি শাশ্বত। তবে নিজেকে নট হিসেবে পরিচয় দিতেই তিনি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
তাঁর রাজনৈতিক মতাদৰ্শ ছিল। সেই মতাদৰ্শকে কোনদিন উপেক্ষা করেননি; তিনি। কল্লোল লেখার জন্য তিনি নাবিকবস্তিতে গিয়ে থাকতে পারেন, আবার অঙ্গার লেখার জন্য কয়লা খনির শ্রমিকদের মধ্যে থাকতে পারেন। শেক্সপিয়ারানা থেকে তাঁর নাটকের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
চল্লিশের দশকে বাংলার মঞ্চ বা রঙ্গালয়ে নতুন এক ধারার নাটকের উদ্ভব ঘটে। বাংলা থিয়েটারে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সূচনা হয়। কালক্রমে তা মূলধারার নাটকে পরিণত হয়। নাট্যচর্চার নতুন ধারায় তরুণ নাট্যসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে নাট্যপত্রের প্রকাশ খুব প্রয়োজন ছিল। নাট্যগোষ্ঠীর সম্পর্কে জানার জন্য সাধারণ মানুষের মনে আগ্রহ থাকে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব হবে? অর্থাৎ মানুষকে নাটক তথা নাট্য আন্দোলন সম্পর্কে জানানোর জন্য একটি পত্রিকা থাকার খুব প্রয়োজন ছিল। যার নাট্যগোষ্ঠীর কার্যকলাপ সম্বন্ধে জানা যেতে পারে। বাংলা থিয়েটারের জগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল ‘বহুরূপী’ পত্রিকা।
১৯৬৪-তে দ্বিতীয় জার্মান সফর থেকে দেশে ফিরে উৎপল দত্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, কিংবদন্তি জার্মান নাট্যকার বের্টল্ট ব্রেখটের স্ত্রী তথা অভিনেত্রী হেলেন ভাইগেলের সঙ্গে এদেশে ব্রেখটের নাট্য আদর্শ প্রচারের একটি ক্ষেত্র তৈরি করবেন তিনি। সেই উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত হল ‘দ্য ব্রেখট সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’। হেলেন ভাইগেল হলেন আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা। আর সভাপতি পদে ছিলেন সত্যজিৎ রায়। সেই সোসাইটির মুখপত্র হিসাবে উৎপল দত্তের হাত ধরে প্রকাশিত হওয়া শুরু করল ‘এপিক থিয়েটার’। ব্রেখট চর্চার কারণেই ‘এপিক’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছিল।
বাংলায় একের পর এক ব্রেখটের নাটক মঞ্চস্থ করা শুরু করে এই সংগঠন। উৎপল দত্ত অভিনয়সহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকলেও, পত্রিকা প্রকাশে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। ব্রেখটের মতো তিনিও থিয়েটারের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে যেতে চেয়েছিলেন এবং পেরেওছিলেন। নাটক ও নাট্য পত্রিকার মাধ্যমে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথাই তিনি বলে গিয়েছেন। কারণ তিনি চাইতেন, নাটকের মধ্যে দিয়ে জনগণ সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের আসল রূপকে চিনে নিন এবং কীভাবে সমাজ বদল সম্ভব, তাও অনুসন্ধান করুক মানুষ। কেবল সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাবেন বলেই, ইংরেজির পরিবর্তে বাংলাভাষায় নাটক মঞ্চস্থ করতে শুরু করেন তিনি। সাধারণ হয়েই সাধারণ কথা বলতেই নাটককে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন উৎপল।
স্রষ্টা হয়ত চিরকাল থাকেন না, কিন্তু কাজের মধ্যে দিয়ে দেশ, কাল, সমাজের জন্য একটি বার্তা দিয়ে যেতে পারেন ভবিষ্যতের জন্য। শোভা সেন তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, “নভেম্বরে আমরা ব্রেখট সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া রেজিস্ট্রি করে তার কাজ শুরু করি পুরোদমে। ‘এপিক থিয়েটার’ পত্রিকাও এই উপলক্ষে প্রকাশিত হতে শুরু করে”। ১৯৭১-এর পর ব্রেখট সোসাইটি অবলুপ্ত হলে ‘এপিক থিয়েটার’কে ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’ দলের মুখপত্র করা হয়। অবশ্য উৎপল দত্তের প্রয়াণের পর বহু বছর ধরে এই পত্রিকার সম্পাদনার হাত বদল হয়েছে। এখন সেই পত্রিকা আর প্রকাশিত হয় না, তবে নাট্য সংস্কৃতির ইতিহাসে নাট্য আন্দোলনের সাক্ষী হিসেবে ‘এপিক থিয়েটার’ পত্রিকা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।