বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

অভিনয় থেকে চিত্রনাট্য লেখক, সব ভূমিকাতেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল শরদিন্দু

March 30, 2023 | 3 min read

সৌভিক রাজ

এম জি রোড, নামটা শুনলেই আরও একটা নাম মনে পড়ে যায়! তিনি বাংলা সাহিত্যের এক মাত্র সত্যান্বেষী। বক্সি, ব্যোমকেশ বক্সি! উত্তর কুমার থেকে রজত কাপুর, আবির, যিশু, পরমব্রত, সুশান্ত সিং রাজপুত কেউই বোধহয় আর বাদ নেই; ব্যোমকেশের ভূমিকায় অভিনয় করতে। সবচেয়ে বেশি ছবি যদি কোনও বাঙালি গোয়েন্দা চরিত্রকে নিয়ে হয়ে থাকে, তবে তার নাম ব্যোমকেশ। এই ব্যোমকেশেরই স্রষ্টা হলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৯৯ সালে আজকের দিনে, মুঙ্গেরে জন্ম গ্রহণ করেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

তাঁর বাবা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ডাকসাইটে উকিল। সব বাবার মতো তাঁরও স্বপ্ন ছিল, তাঁর মতোই উকিল হোক ছেলে। কিন্তু ছেলের মাথায় ততদিনে সাহিত্য, বাংলা ভাষার নেশা জাঁকিয়ে বসেছে। ছোট থেকেই তাঁর ছিল পড়ার শখ। লিখতেও এসে পড়েছিলেন হঠাৎ করেই। স্কুলে পড়াকালীন বাংলার শিক্ষক বলেছিলেন, কবিতা লেখার চেষ্টা করতে। যার লেখা ভাল হবে, সে প্রাইজ পাবে! ব্যস, সোনায় সোহাগা, সেইদিন সেখান থেকেই লেখার ভূত চাপল মাথায়। ম্যাট্রিকের পর ছুটিতে মামার বাড়ি গিয়ে লিখে ফেললেন আস্ত একটা উপন্যাস। বেশ কয়েক বার চেষ্টা করেও তা ছাপানো যায়নি। সেটাই পরবর্তীতে সুপারহিট ছবি। আজ্ঞে হ্যাঁ, ড্রয়ারেই পড়ে ছিল ‘দাদার কীর্তি’। ১৯১৫ সালে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হলেন শরদিন্দু। কলকাতায় থাকাকালীন প্রথম পাঁচ বছর তিনি ওয়াইএমসিএ-এর হস্টেলে এবং তারপরে মেস ছিলেন। মেস অর্থাৎ প্রথমে সিমলা স্ট্রিট এবং তারপরে বাদুড়বাগান ঘুরে হ্যারিসন রোড। এই হস্টেলেই অজিত সেনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। ওই সময়ে তাঁর সাহিত্যচর্চার দোসর হয়ে ওঠেন অজিত। এক দিকে তিনি লিখছেন, অন্য দিকে তাঁর বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেছেন উকিল বাবা, মুঙ্গেরে বাবার সহকর্মী আইনজীবীর কন্যা পারুল।

বন্ধু অজিত আর অতুল মিত্রের উৎসাহে কবিতার বই বেরোলো, নাম ‘যৌবনস্মৃতি’। বাবার জুনিয়ার হিসেবে ওকালতি করছিলেন তিনি, বসুমতীতে ছাপা হল তাঁর প্রথম গল্প ‘উড়ো মেঘ’। এরপরে ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’ও তাঁর লেখা প্রকাশ হতে থাকল। ১৯২৯ সালে শরদিন্দু ওকালতিকে আলবিদা জানালেন। ১৪ বছরের ব্যবধানে তাঁর দ্বিতীয় বই গল্পগ্রন্থ ‘জাতিস্মর’ প্রকাশ পেল। সাহিত্যিক হিসেবে ততদিনে বাজিমাত প্রায় করেই ফেলেছেন শরদিন্দু।

বম্বে টকিজের জন্যে হন্যে হয়ে চিত্রনাট্যকার খুঁজছেন হিমাংশু রায়। কলকাতায় তারাশঙ্করকে অনুরোধ করেছেন, তিনি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। হিমাংশু রায়ের ভগ্নীপতি, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তখন প্রস্তাব করলেন শরদিন্দুর নাম। ছাত্রজীবন থেকেই শরদিন্দুর সিনেমার নেশা ছিল। অভিনয়ও করেছিলেন বেশ কয়েকবার। ১৯৩৬-এর রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রেডিয়োয় লেখকদের নিয়ে ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ অভিনয় হয়। শরদিন্দু কেদারের চরিত্র করেন। বন্ধু পরিমলের গোস্বামীর লেখা কৌতুকনাটিকার একটা রেকর্ডে সরযূবালার ভূমিকায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গেও অভিনয় করেছিলেন শরদিন্দু।

‘ভাবী’, ‘বচন’, ‘দুর্গা’, ‘কঙ্গন’, ‘নবজীবন’, ‘আজাদ’, ‘পুনর্মিলন’ বম্বে টকিজের এই সাতটি ছবির গল্প লিখেছিলেন শরদিন্দু। ইংরেজিতে লিখতেন, হিন্দিতে তর্জমা করে নেওয়া হত। বাণিজ্যিক ফরমায়েশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অসহ্য হয়ে উঠেছিলেন। অনুভব করছিলেন, সিনেমায় টাকার এতই প্রভাব যে নিজের মতো করে গল্প বলা অসম্ভব। তাঁর চিত্রনাট্য নিয়ে দুটি বাংলা ছবিও হয়েছিল সেই সময়, ‘দেবদূত’ ১৯৪৮ সালে এবং ‘বিষের ধোঁয়া’ ১৯৪৯ সালে। দুটোর পরিচালকই ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়। বম্বে টকিজ শরদিন্দুর গল্প ‘নিশাচর’ নিয়েও ছবি করেছে।

বম্বে টকিজেরই পরিচালক এন আর আচার্য নিজের প্রোডাকশন সংস্থা খুলেছিলেন, বম্বে টকিজ ছেড়ে আসার পরে শরদিন্দু সেখানেও ফ্রিল্যান্স ভিত্তিতে চিত্রনাট্য লেখা শুরু করছিলেন। সে সময়ে মালাডের স্টুডিয়োর কাছেই থাকতেন তিনি।

অন্যদিকে ১৯৩২ সালেই চলে এসেছেন ব্যোমকেশ। আষাঢ়, অঘ্রান আর মাঘের ‘বসুমতী’তে পরপর তিনটি গল্প প্রকাশ পেয়েছে। ‘পথের কাঁটা’, ‘সীমন্তহীরা’ আর ‘সত্যান্বেষী’। পরের বছর ১৯৩৩-এ ঐ তিনটির সঙ্গে ‘মাকড়সার রস’ গল্পটি যোগ করে প্রকাশ পেল ব্যোমকেশের প্রথম বই, ‘ব্যোমকেশের ডায়েরি’। অজিত, অতুল, হ্যারিসন রোডের মেস এবং শরদিন্দু নিজে, বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব পেয়ে গেলেন। তখন কলকাতায় মেসখরচ আর অন্যান্য খরচা মিলিয়ে শরদিন্দুর মাসে তিরিশ টাকা খরচ হত, ব্যোমকেশের গল্পে অজিতের মাসখরচ দেখানো হল পঁচিশ টাকা। এ যেন তাঁদেরই গল্প। নিজের চেয়ে নয় বছরের ছোট করলেন ব্যোমকেশকে। ব্যোমকেশকে নিয়ে বড্ড খুঁতখুঁতে ছিলেন শরদিন্দু। সত্যজিৎ রায় যখন চিড়িয়াখানা বানালেন, তখন চশমা পরা ব্যোমকেশ দেখে বেজায় চোটে গিয়েছিলেন তিনি।

পুণেতে থাকছেন শরদিন্দু, এদ্দিন দুটি চরিত্র ছিল গল্পে। এবার নতুন একটি চরিত্র এল, মহিলা চরিত্র। নারী চরিত্রটি আর কেউ নয় সত্যবতী, আর গল্পটা ছিল ‘অর্থমনর্থম’।

১৯৬৮ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘বেণীসংহার’ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু শরদিন্দু খুশি নন! তিনি ব্যোমকেশের রিটায়ারমেন্ট নিয়ে ভাবছেন। তাঁর নিজের কথায়, ‘ব্যোমকেশের প্রতি আমার একটা কর্তব্য আছে তো! সে আর কত পারবে!’
লেখা কিন্তু থামেনি। বরং ব্যোমকেশের নতুন গল্প নিয়ে বন্ধু প্রতুলচন্দ্রকে আগাম বলে রেখেছিলেন, ‘সত্যবতীর গাড়ি হবে। কিন্তু একটা খুনের মামলায় পুলিশ আপনাকে কিরকম নাস্তানাবুদ করে দেখবেন।’

‘বিশুপালবধ’- গল্পে সত্যিই প্রতুলবাবু নামে সত্যিই একটি চরিত্র ছিল। কিন্তু গল্প লিখে শেষ করার আগেই তাঁর নিজের অবসর নেওয়া হয়ে গেল, ১৯৭০ সনের ২২ সেপ্টেম্বর মারা গেলেন ব্যোমকেশের স্রষ্টা। পরে এই অসমাপ্ত লেখাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছিলেন নারায়ণ সান্যাল। শরদিন্দুর অনুকরণ করেননি। এ ছিল নারায়ণ সান্যালের নিজের এক ব্যোমকেশ, অজিত আর সত্যবতী। তবু্ও পড়ে বোঝার উপায় নেই যে দুটো আলাদা লেখকের লেখা। বিশুপাল বধকে সত্যি সত্যিই মন থেকে গ্রহণ করেছিলেন ব্যোমকেশ অনুরাগীভক্তেরা। 

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Writer, #birth anniversary, #Author, #Saradindu Bandopadhyay

আরো দেখুন