Good Friday: ইতিহাসে আজও উজ্জ্বল kolkata-র প্রাচীন এই চার্চগুলি
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: কলকাতায় যখন ইউরোপীয়া বাস করতেন তখন থেকেই এখানে গড়ে উঠেছিল একের পর এক চার্চ। ক্রমশ এই নগরী হয়ে ওঠে সব ধর্মের মিলনস্থল। এখানে রয়েছে সবথেকে বড়ো ক্যাথিড্রাল এবং এশিয়ার সবথেকে পুরোনো এপিস্কোপাল গির্জা। কলকাতার এই সব গির্জার স্থাপত্য, ভাস্কর্য, অলংকরণ এবং শান্ত সমাহিত পরিবেশ আজও সব ধর্মের মানুষকে আকর্ষণ করে।
১) সেন্ট জর্জ চার্চ/ পাথুরে গির্জা St George’s Church (বিবাদিবাগ)
১৭৫৬ তে সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণকালে পুরনো সেন্ট অ্যানিস চার্চ ধ্বংস হয়ে যায়। তখন ইংরেজরা সাময়িকভাবে মুরগিন হাটার পোর্তুগীজ চার্চটিকে ব্যবহার করতেন।
১৭৬০-এ গির্জাটি পুনরায় পর্তুগীজদের ফেরত দেওয়া হয়। লন্ডনের বোর্ড অফ ডাইরেক্টর্স ইংরেজদের অসুবিধের কথা মাথায় রেখে নতুন গির্জা তৈরির পরিকল্পনা করেন। খোঁজখবর করে লালদিঘির দক্ষিণ পশ্চিম কোণে কোম্পানির পুরনো বারুদ গোদামের জায়গাটিতে গির্জা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়, কিন্তু ৪ বিঘা ১০ কাটা মাপের ওই জমিদার নবকৃষ্ণ দেব আগেই কিনেনিয়েছিলেন। পরে গির্জা তৈরির কথা জানতে পেরে তিনি জমিটি চার্চ কমিটিকে দান করেন। ওই জমির পাশে ছিল ইংরেজদের প্রাচীন এক কবর খানা। জব চার্নকের কবরটি রয়েছে ওই কবরখানাতেই। এরই সমাধির ফলকে লেখা আছে তাঁর মৃত্যু সাল ১৬৯২। এই সমাধিসৌধের পাশের জায়গায় রয়েছেন চার্নকের দুই কন্যার সমাধি।
এখানে রয়েছে বাদশা ফররুখসিয়ারের কাছ থেকে ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার ফরমান নিয়ে আসা চিকিৎসক উইলিয়াম হ্যামিল্টনের সমাধিও। এই চার্চে আছে একটি মনুমেন্ট। হেনরি ক্লিন্টনের লেখা থেকে জানা যায়, প্রাচীন গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে চার্চ তৈরির জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল মার্বেল পাথর। এই গির্জাটি ১৭৮৭ সালে গ্রিস স্থাপত্যের নিদর্শন লন্ডনের সেন্ট স্টিফেন চার্চের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে। পুরোটাই পাথরের তৈরি বলে লোকমুখে এটার নাম হয় পাথরের গির্জা।
২) আর্মেনিয়ান চার্চ-Armenian Church Bortola, Barabazar Market
আর্মেনিয়ান চার্চ কলকাতার প্রাচীনতম গির্জা হিসাবে পরিচিত। ১৭২৪ সালে আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের পুরনো কবর স্থানের জায়গায় এই চার্চটি গড়ে তোলা হয়। আর্মেনীয়রাই প্রথম ভারতে খ্রিস্টধর্ম নিয়ে আসে। কলকাতার আর্মেনিয়ান চার্চ “ভারতীয় আর্মেনিয়ানদের মাদার চার্চ” নামেও পরিচিত। আর্মেনিয়ান চার্চের বেদীটি ইংরেজ শিল্পী হ্যারিসের তিনটি চিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেগুলি হল “হলি ট্রিনিটি”, “লাস্ট সাপার” এবং “দ্য এনশ্রুডিং অফ আওয়ার লর্ড”।
ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য অনুসারে, ১৬৮৮তে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের সাথে একটি চুক্তির মাধ্যমে এখানে প্রথম কাঠের গির্জা তৈরি করেছিল। চুক্তি অনুসারে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতের সমস্ত কোণে গির্জা নির্মাণ করার কথা ছিল যেখানে কমপক্ষে ৪০ জন আর্মেনিয়ান বসবাস করবে। প্রাক্তন তার পারিশ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত পুরোহিতকে ৫০ পাউন্ড মঞ্জুর করবে। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বর্তমান আর্মেনিয়ান চার্চের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি ছোট কাঠের গির্জা নির্মাণ করেছিল। পরে সেই কাঠের গির্জাটি অগ্নিকাণ্ডের কারণে ধ্বংস হয়েগিয়েছিল।
বর্তমান গির্জাটি ১৭৩৪ সালে একই স্থানে আর্মেনিয়ান আগা মামেদ হাজার মালিয়ার দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। গির্জার সুন্দর বেদীটি একটি পবিত্র ক্রস, গসপেল পাঠ্য এবং যীশু খ্রিস্টের ১২টি প্রেরিতের প্রতীক ১২টি মোমবাতি দিয়ে সজ্জিত। এখানে একটি বিস্ময়কর ঘড়ি রয়েছে। গির্জা প্রাঙ্গণটিতে রয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মারা যাওয়া অগণিত আর্মেনিয়ানদের স্মৃতিস্তম্ভ।
৩) সেন্ট পল ক্যাথিড্রাল চার্চ St. Paul’s Cathedral, 1A, Cathedral Road
তিলোত্তমা কলকাতায় এশিয়ার সবথেকে পুরোনো এপিস্কোপাল গির্জা হল সেন্ট পল ক্যাথিড্রাল চার্চ। ১৮১৯ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল মার্কুইস অফ হেস্টিংসের সময়ে নতুন ক্যাথিড্রাল তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। ক্যাথিড্রালটি কোথায় অবস্থান করবে, তা ঠিক করেন বিশপ মিডলটন। তবে নির্মাণকার্য শুরু হওয়ার আগেই মারা যান তিনি। শেষ পর্যন্ত ১৮৩২ সালে বিশপ ড্যানিয়েল উইলসনের উদ্যোগে ক্যাথিড্রাল নির্মাণের প্রকল্প ফের গ্রহণ করা হয়। সেন্ট পলস গির্জার নকশা করেছিলেন সামরিক ইঞ্জিনিয়ার মেজর উইলিয়াম ফোরবস। সিকে রবিনসন গির্জার টাওয়ার ও চূড়ার নকশা করতে ফোরবসকে সাহায্য করেছিলেন। ১৮৩৯ সালে এই গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়, এবং ১৮৪৭ সালের ৮ অক্টোবর জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় গির্জাটি। এখানে রক্ষিত রুপোর গিলটি করা ধাতব মানপত্র পাঠিয়েছিলেন সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া। গির্জার উদ্বোধন করেছিলেন বিশপ উইলসন।
৪) জোড়া গীর্জা St. James Church-
জোড়া গির্জাটির আসল নাম হলো ‘সেন্ট জেমস চার্চ। এটি কলকাতার সবথেকে বড়ো প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ। এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ইংরেজি ১৪ই নভেম্বর ১৮২০ সালে।
মোটামুটি একসাথে ৬০০ জন বসে উপাসনা করতে পারেন এই চার্চে। এখানে রয়েছে একটি ছোট চ্যাপেল, যেখানে মেয়েরা আলাদা করে প্রার্থনা করতে পারবেন, যা ‘লেডিস চ্যাপেল’-নামে পরিচিত। চার্চের ভিতরের দক্ষিণ দিকের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে যীশুর বিচার থেকে শুরু করে ক্রুশে আত্মবলিদান ও সমাধিদান পর্যন্ত ১৪টি দেওয়াল চিত্রের প্রদর্শনী। গির্জার ডানদিকের দেওয়ালে রয়েছে একটি অতীব সুন্দর অয়েল-পেন্টিং, যার বিষয়বস্তু হলো শিশু-যীশু, মাদার মেরী এবং জোসেফ।
ইংরেজী ৭ই জুন ১৮৬২ সালে, বাংলার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্ণর জন পিটার গ্রান্ট, চার্চের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পুরাতন চার্চের কোনো চূড়া বানানো হয় নি, পরে কর্তৃপক্ষ এই চার্চের একটার বদলে দুটো চূড়া বানিয়েছিলেন। স্থানীয়রা তাই এই গির্জার নাম রাখেন ‘জোড়া গির্জা’।
৫) সেন্ট অ্যান্ড্রু চার্চ- St. Andrew’s Church, Dalhousie Square
ডালহৌসি স্কোয়ারের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চের আরও দুটি নাম রয়েছে; স্কচ কার্ক এবং লাট সাহেব কা গির্জা। এটি কলকাতার স্কটিশ প্রেসবিটেরিয়ান সম্প্রদায়ের সেবা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। কোর্ট অফ ডিরেক্টরস এই চার্চের বিল্ডিংয়ের জন্য প্রাক্তন ওল্ড কোর্ট হাউসের প্লটটি বরাদ্দ করে এবং ১,০০,০০০ রুপি প্রদান করেছিল।
এটি কলকাতার বিরল চার্চগুলির মধ্যে একটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চার্চ। রবিবার করে এখানে আরাধনা ও ধর্মসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেন্ট অ্যান্ড্রু’স চার্চ ১৯৭০ সালে সিএনআই-তে যোগ দেয়।
৬) গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ- The Greek Orthodox Church 2a Library Road, Kalighat
১৯২৪ সালে পঞ্চম জর্জ যুক্তরাজ্য ও ব্রিটিশ অধিরাজ্য সমূহের রাজা থাকাকালীন এই চার্চটি নির্মিত হয়েছিল। সাবেক স্থাপত্যের বহু নিদর্শন এখানে দেখতে পাওয়া যায়।
সে সময়কালে এই গির্জার হাল ধরেছিলেন গ্রিক ফাদার ইগনেশিওস সেনিস। কালো পোশাক পরিহিত সন্ন্যাসিনী সিস্টার নেকতারিয়া পারাদিসির এই গির্জার সমৃদ্ধ হয়েছিল। তৎকালে প্রায় শ’খানেক দরিদ্র ভোজনে দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। প্রাক্তন গ্রিক প্রেসিডেন্ট স্তেফানোপুলোস, প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপানদ্রু কিংবা কনস্তান্তিনোপ্লের আর্চবিশপ বার্থলোমিউয়ের মতো মান্যগণ্যরাও এ গির্জায় এসেছিলেন।
গ্রিক লিপি খচিত এই গির্জার প্রার্থনা ঘরে সোনা-রুপোর সাজের যীশু-মেরির ‘ইকোনা’/প্রতীক বা চতুর্থ শতকের শহিদ খ্রিস্টান সন্ত ক্যাথারিনের ছবি রাখা আছে। গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ যেন তিলোত্তমা কলকাতা নগরীতে এক টুকরো গ্রিস। ইতিহাসের একটা বিস্মৃত অধ্যায়।