জরুরি অবস্থার সময়কালের দুঃস্বপ্নের স্মৃতি কি আবার ফিরে আসছে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সৌজন্যে?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সময়কালের সেই হাড় হিম করা দুঃস্বপ্নের স্মৃতি কী আবার ফিরে আসছে? হ্যাঁ আমরা সেই হাড় হিম করা জরুরী অবস্থার কথাই বলছি। দুঃস্বপ্নের স্মৃতিকে আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া আজকের ভারতের পটভূমিতে আরো আরো জরুরি হয়ে পড়েছে।
কারণ, তথ্য প্রযুক্তি বিধি (২০২১) এ সংশোধন এনেছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। এই সংশোধনী অনুযায়ী, সোশ্যাল মিডিয়ায় কেন্দ্র সরকার সম্পর্কে উপস্থাপিত কোনও তথ্য ‘ভুয়ো’ বা ‘মিথ্যা’ বা ‘বিভ্রান্তিকর’ কিনা যাচাই করতে একটি সংস্থা তৈরি করবে কেন্দ্র সরকার। সেই সংস্থা যদি মনে করে ওই তথ্য ‘ভুয়ো’ বা ‘বিভ্রান্তিকর’, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তা তুলে দিতে হবে। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সাংবাদিকদের সংগঠনগুলি।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে খানিকটা চুপিসারেই এই সংশোধনী আনা হয়েছে। কারণ তথ্য প্রযুক্তি আইনে রদবদল করতে হলে সংসদে আলোচনার প্রয়োজন হয়, সংসদের অনুমোদন লাগে। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিকস ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রকের তরফ থেকে এক নোটিস জারি করে সংশোধনীর বিষয়ে জানানো হয়েছে।
সে ছিল ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সময়কাল। প্রবল শক্তিধর ইন্দিরা গান্ধী তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নির্দেশেই সরকার সরাসরি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করল। সরকারি নির্দেশিকায় বলা হল, সংবাদ প্রকাশের আগে তা সরকারি কর্তাদের দেখিয়ে ছাপার অনুমোদন নিতে হবে। কর্তারা কোনও সংবাদ ‘প্রকাশের অযোগ্য’ মনে করলে তা ছাপা যাবে না। আটচল্লিশ বছর পরে স্বাধীন সংবাদ বা তথ্য প্রকাশের উপর জরুরি অবস্থার সেই কালো ছায়া ফের যেন নেমে এসেছে। ইন্দিরার জমানায় অনলাইন বা সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। এমনকী অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমও তেমন খুঁজে পাওয়া যেত না। তাই মূলত প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদমাধ্যম, সাদা কথায় মূলত সংবাদপত্রের উপরই সেন্সরশিপের খাঁড়া নেমে এসেছিল। কিন্তু এই ২০২৩-এর ডিজিটাল যুগে অনলাইন, গুগল ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া তথ্য ও সংবাদ প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকার তাই সংসদকে এড়িয়ে আইন সংশোধন করে ঠিক করেছে, এইসব মাধ্যম সরকার বা সরকারি তথ্য সম্পর্কে কোনও ভুল, মিথ্যা বা অসদ-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভ্রান্তিমূলক খবর প্রচার করছে কি না, তা খতিয়ে দেখবে সরকার নিয়োজিত একটি ফ্যাক্ট চেকিং কমিটি। এই কমিটির সদস্যদের ঠিক করবেন সরকারই। কোনও তথ্য বা খবর সম্পর্কে এই কমিটির আপত্তি থাকলে সংশ্লিষ্ট মাধ্যমকে তার প্ল্যাটফর্ম থেকে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। তা না হলে আইনের রক্ষাকবচ থেকে বঞ্চিত হবে সেই মিডিয়া। সরকারের এই নয়া ফরমানে কোপে পড়বে জিও এয়ারটেল ভোডাফোনের মতো সংস্থা, যারা মোবাইল ইন্টারনেটের পরিষেবা দেয়। ব্যক্তিগতভাবেও যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য দেন, মন্তব্য করেন—নতুন সংশোধনীর কোপে তাঁরাও পড়বেন। অর্থাৎ সেই একই কণ্ঠস্বর। সেই একই খবরদারি বা নজরদারির চেষ্টা! শুধু সংবাদমাধ্যমের চেহারাটা বদলে গিয়েছে।
মোদী সরকার যেদিন এই নির্দেশ দিল, তার ২৪ ঘণ্টা আগে একটি মালয়লম টিভি চ্যানেলকে নিষিদ্ধ করার কেন্দ্রীয় নির্দেশ খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছিল, দেশে এখন জাতীয় সুরক্ষার নামে নাগরিক অধিকার হরণের প্রক্রিয়া চলছে। ঘটনাও তাই। মোদী জমানায় গত ন’বছরে সরকার ও শাসকদলের নানা কুকীর্তির কথা আলোর গতিতে পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে অনলাইন বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এটা যে শাসক শিবিরের পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তির কারণ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতেও পরিষ্কার, এই অস্বস্তি ক্রমশ হাজারও প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। গ্যাসের দাম, বেকারের সংখ্যা, দারিদ্র্যে দেশের অবস্থান কোথায়, অনলাইনে তার হাতেগরম তথ্য উঠে আসছে। আবার আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বা শীর্ষ নেতৃত্বের ‘সম্পর্ক’, মোদির শিক্ষাগত যোগ্যতার শংসাপত্রের প্রসঙ্গ নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব উপস্থিতি সরকার ও শাসকদলের ভাবমূর্তি নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। অতএব লোকসভা ভোটের আগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে এই সর্বগ্রাসী প্রচারের মুখ বন্ধ করতে তৎপর হল গেরুয়া শিবির।
ইতিমধ্যেই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়া বলেছে, দেশের সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার উপরে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এই সংশোধনী। এডিটর্স গিল্ড একে দানবীয় সংশোধনী বলেও অভিহিত করেছে এবং প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।
এক বিবৃতিতে এডিটর্স গিল্ড বলেছে, সোস্যাল মিডিয়ায় কেন্দ্র সংক্রান্ত কোনও পোস্ট ‘ভুয়ো’ বা ‘মিথ্যা’ বা ‘বিভ্রান্তিকর’ কি না, এই সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চরম ক্ষমতা নিজেই নিজেকে দিয়েছে। সেই সঙ্গে সংশোধনীতে বলা হয়েছে, পিআইবি বললেই এমন পোস্টকে সরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে সোস্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি। কিন্তু সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্টের সত্যতা যাচাই করার সরকারি পদ্ধতি বা কাঠামো কী হবে। বিজ্ঞপ্তিতে পিআইবি’র সিদ্ধান্তের বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনা বা তার বিরুদ্ধে আপিলের অধিকার নিয়েও কিছু বলা হয়নি। শ্রেয়া সিঙ্ঘল বনাম ভারত সরকারের মামলায় সোস্যাল মিডিয়ার পোস্ট মুছে দেওয়া বা সোস্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্লক করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট কিছু নির্দেশিকা ঠিক করে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে তা কীভাবে মেনে চলা হবে, তাও জানানো হয়নি সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে। এই সবই ন্যায়বিচারের নীতির পরিপন্থী এবং সেন্সরশিপের সমতুল। গিল্ডের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, গত জানুয়ারিতে একবার এমন কিছু সংশোধনীর খসড়া প্রকাশ করেছিল তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক। সারা দেশের সংবাদ মাধ্যম সংগঠনগুলির সমালোচনার মুখে পড়ে মন্ত্রক তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তখন গিল্ড বলেছিল, ভুয়ো খবরকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা শুধু সরকারের হাতে থাকতে পারে না। তাতে সংবাদ মাধ্যম সেন্সরশিপের শিকার হবে। সেই সময়ে বিষয়টি নিয়ে অর্থপূর্ণ আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু কোনও আলোচনা ছাড়াই তথ্য প্রযুক্তি বিধি (২০২১) সংশোধন করে এবার বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। বাস্তবে এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দানবীয় বিধি আরোপ করা হয়েছে।
অনলাইন বা সোশ্যাল মিডিয়ার মুখ বন্ধের চেষ্টার নরেন্দ্র মোদীর সরকারের এই নবতম সংযোজনে তাই অনেকেই জরুরি অবস্থার সময়কালের সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করে দিয়েছেন।