আতিক হত্যাকাণ্ড: ‘রাষ্ট্রের’ হাত? যোগীর ‘ঠোক দো’ ফর্মুলা নিয়ে সরব বিভিন্ন মহল
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হেফাজতে থাকা প্রাক্তন সাংসদ তথা ‘গ্যাংস্টার’ আতিক আহমেদ এবং তাঁর ভাই আশরফ খুনের তিন দিন পরও বিতর্ক থামছে না। অনেকেই এই ঘটনার জন্য উত্তরপ্রদেশ সরকারের দিকে আঙ্গুল তুলছেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত দেখছেন। এরই মধ্যে এই বিষয়ে মুখ খুলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। কোনওরকম সরাসরি মন্তব্য না করলেও লখনৌয়ের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশে কোনও মাফিয়া আর শিল্পপতিদের হুমকি দিতে পারবে না।’’
আতিক আহমেদ ও তাঁর ভাই আশরাফ আহমেদ হত্যার তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ রাজ্য পুলিশ তিন সদস্যের এক বিশেষ তদন্ত দলও গঠন করেছে। সেই দলের তদন্ত ঠিকমতো হচ্ছে কি না, দেখতে গড়া হয়েছে আরও এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি। তাতে এই হত্যা রহস্যের কিনারা কতটা হবে, সেই প্রশ্ন ছাপিয়ে উঠে এসেছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যাতে পুলিশের গাফিলতি স্পষ্ট। আর এসব প্রশ্ন থেকেই জন্ম এই জোড়া খুনে ‘রাষ্ট্রের’ হাত ছিল কি না।
প্রশ্নটা উঠছে। কারণ, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ একাধিকবার বলেছেন, রাজ্য থেকে ‘গুন্ডা ও মাফিয়ারাজ’ পুরোপুরি খতম করে দেবেন। ইতিমধ্যেই তাঁর রাজত্বে শতাধিক এ ধরনের খুনের ঘটনা ঘটেছে। রাজ্য পুলিশের রেকর্ড বলছে, ২০১৭ সাল থেকে আদিত্যনাথের রাজত্বে মোট ১০ হাজার ৯০০টি ‘এনকাউন্টার’–এর ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১৮৩ ‘অপরাধী’ নিহত হয়েছেন বলে সম্প্রতি পিটিআইকে জানিয়েছেন রাজ্য পুলিশের স্পেশাল ডিরেক্টর জেনারেল (আইনশৃঙ্খলা) প্রশান্ত কুমার। পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৩ পুলিশ কর্মীও নিহত হয়েছেন। ৫ হাজার ৪৬ জন আহত হয়েছেন। ২৩ হাজার ৩০০ ‘অপরাধীকে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টকে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে ইতিমধ্যেই আর্জি জানানো হয়েছে।
আতিক–আশরাফ হত্যা তদন্তে রাজ্য সরকার গতকাল রোববারই এলাহাবাদ হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অরবিন্দ কুমার ত্রিপাঠির নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিটি করেছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ব্রিজেশ কুমার সোনি ও রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন শীর্ষ আধিকারিক সুবেশ কুমার সিং। বিচার বিভাগীয় এই তদন্তের পাশাপাশি গড়া হয়েছে রাজ্য পুলিশের এক বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। এর নেতৃত্বে রয়েছেন প্রয়াগরাজ পুলিশ ক্রাইম ব্রাঞ্চের তিন উচ্চপদস্থ কর্তা। নেতৃত্বে রয়েছেন, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার সতীশ চন্দ্র, সহকারী কমিশনার সত্যেন্দ্র তিওয়ারি ও ক্রাইম ব্রাঞ্চের তদন্তকারী অফিসার ওম প্রকাশ। ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে’ এই দলকে ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে’ সব দিক খতিয়ে তদন্ত শেষ করতে বলা হয়েছে।
মজার কথা, সিটের তদন্ত তদারকি করতে আবার গড়া হয়েছে এক ‘সুপারভিশন’ দল। এই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন রাজ্য পুলিশেরই এক কর্তা আর কে বিশ্বকর্মা। এত কিছুর প্রয়োজনীয়তা কেন এবং এতে কাজের কাজ কতটা হবে, সেই প্রশ্ন রাজনৈতিক মহল ও সামাজিক মাধ্যমে উঠতে শুরু করেছে।
এসব প্রশ্নের মধ্যেই তিন আততায়ী সানি সিং, অরুণ মৌর্য ও লাভলেশ তিওয়ারিকে সোমবার প্রয়াগরাজ নৈনি সেন্ট্রাল জেল থেকে নিরাপত্তার খাতিরে প্রতাপগড় জেলা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের সন্দেহ, ওই তিন আততায়ী আক্রান্ত হতে পারেন।
প্রশ্ন উঠেছে, নিরাপত্তাই যদি কারণ হয়ে থাকে, তা হলে তিন সন্দেহভাজন খুনিকে কেন একই কারাগারে রাখা হয়েছে? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর রাজ্য প্রশাসনের কাছে নেই। যেমন নেই অত্যন্ত গুরুতর কিছু প্রশ্নের জবাব। প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বাল এক টুইটে সেসব প্রশ্ন তুলে ধরে এই ঘটনাকে ‘আর্ট অব এলিমিনেশন’ বলে কটাক্ষ করেছেন। সামাজিক মাধ্যমও এ নিয়ে সরব।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে দাবি, অকুস্থলে সাংবাদিক সেজে আসা তিন আততায়ীকে পুলিশের গাড়ি থেকেই নামতে দেখা গেছে। এই হত্যাকাণ্ডের ‘প্রকৃত মদদদার’ কারা, তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
কপিল সিব্বালের প্রথম প্রশ্ন, কেন রাত ১০টায় দুই ভাই আতিক ও আশরাফকে হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আনা হয়? কোনও জরুরি মেডিকেল কারণ ছিল কি? এত ঝুঁকিপূর্ণ দুই অপরাধীকে কেন হাসপাতালের বাইরে গাড়ি থেকে নামানো হলো? গাড়ি কেন হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো না? কেন তাঁদের সর্বসমক্ষে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল? দুই ভাইকে হত্যা করে তিনজনই আত্মসমর্পণ করলেন?
প্রশ্ন তুলেছে সংবাদমাধ্যমও। আতিকের শরীরে নয়টি ও আশরাফের শরীরে পাঁচটি বুলেট ক্ষত পাওয়া গেছে। টানা ২২ সেকেন্ড ধরে মোট ২০টি গুলি চালাল ৩ খুনি, অথচ পুলিশ একটি গুলিও ছুঁড়ল না কেন? হত্যার পর ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে দিতে তাঁরা আত্মসমর্পণ করলেন! আতিক ও আশরাফের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাঁদের ওপর ছিল, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার এখনও কর্তব্যে গাফিলতির কারণে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি!
অন্যদিকে আতিক আহমেদ হত্যা মামলার অভিযোগ গ্রহণ করল সুপ্রিম কোর্ট। আগামী সোমবার অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল এই মামলার শুনানির দিন স্থির করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে যে পিটিশন দাখিল করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক ১৮৩টি এনকাউন্টারের মামলায়। এ ছাড়াও পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন কীভাবে আতি এবং আশরফের মৃত্যু হল সে বিষয়েও তদন্ত করা হোক।” আরও বলা হয়েছে যে, পুলিশের এই ধরনের পদক্ষেপ গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের পরিপন্থী। গণতান্ত্রিক সমাজে পুলিশকে চূড়ান্ত বিচারের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে না।শাস্তির বিষয়টি বিচারবিভাগের অধীনেই থাকা উচিত।
উল্লেখ্য, আতিক এবং তাঁর ভাই আশরফ যে দিন খুন হন, তার ৪৮ ঘণ্টা আগেই ঝাঁসিতে পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছিল আতিকের তৃতীয় পুত্র আসাদের। ওই একই ঘটনায় ‘এনকাউন্টারে’ নিহত হয়েছিলেন আসাদের সঙ্গী গুলামও।