দেশ বিভাগে ফিরে যান

নয়া দূরদর্শনের তথ্যচিত্রে কি BJP’র উত্থানের কাহিনিই তুলে ধরা হচ্ছে?

April 25, 2023 | 4 min read

তথ্যচিত্রটির নাম, ‘ধরোহর ভারত কি পুনরুথান কি কাহানি’।

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: প্রতিটি জাতির জন্য, তার অতীত জানা জরুরী। ‘কিন্তু সেই জাতি যে ইতিহাসটা জানছে তা কতটা সঠিক সেটি কে বলবে? কারণ, সেটা নিয়েই অনেক সময়ই তৈরি হয় বিতর্ক।

কেউ যখন আমাদের প্রশ্ন করে, আমাদের জাতীয় পরিচয় কি, নির্দ্বিধায় উত্তর দিই – আমরা ভারতীয়। কোন প্রাতিষ্ঠানিক আবেদনপত্রে স্বীকার করি – আমরা ভারতীয়। আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে কেন্দ্র করে বাজারে পাওয়া যায় অনেক রকম বই। আবার এই জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে হয়েছে যুদ্ধ। কিন্তু কী এই জাতীয়তাবাদ যা আমাদের কেবল পরিচয়ই নয়, আবেগ অনুভূতির সাথেও মিশে রয়েছে? কেমন লাগবে যদি কেউ হঠাৎ বলে বসে – ভারতীয় জাতিস্বত্বা একটা কাল্পনিক ধারণা? ঠিক এভাবেই জাতীয়তাবাদের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন। কল্পনাপ্রসূত জাতিসত্ত্বার এই ধারণা নিয়ে ১৯৮৩ সালে বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন রচনা করেন তার বিখ্যাত বই ‘Imagined Communities : Reflections on the Origin and Spread of Nationalism‘।

বইয়ের সূচনাপর্বেই অ্যান্ডারসন বলেছেন, “Nationality, Nation-ness, as well as Nationalism, are cultural artefacts of a particular kind” – জাতীয়তাবাদ এক বিশেষ ধরনের সাংস্কৃতিক নির্মাণ। কিন্তু ইতিহাসে কিভাবে এই নির্মাণের সূচনা হলো, এর অর্থই বা কিভাবে বদলে গেল, সতেরো শতকের শেষদিকে কোন মোড়ে গিয়ে জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রকট হয়ে উঠলো এবং কিভাবে আমাদের অনুভূতির সাথে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক জড়িয়ে পড়লো এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অ্যান্ডারসন তার বইয়ে। জাতীয়তাবাদের কোন সুনির্দিষ্ট ও “বৈজ্ঞানিক” সংজ্ঞার অভাব অনুভব করে অ্যান্ডারসন নৃবৈজ্ঞানিক চিন্তার আলোকে সংজ্ঞা দিয়েছেন, “it is an imagined political community and imagined as both inherently limited and sovereign” – এটি একটি কাল্পনিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যা একইসাথে সীমিত ও সার্বভৌম। (এখানে ‘Community’ শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে ‘গোষ্ঠী’)।


অ্যান্ডারসন তার সংজ্ঞায় তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। জাতীয়তাবাদের ধারণা কাল্পনিক, সীমিত ও সার্বভৌম। কাল্পনিক একারণে যে একটা জাতির প্রতিটা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ নেই, একটা জাতির প্রতিটা সদস্য প্রত্যক্ষভাবে একে অপরকে চেনে না, জানে না। কিন্তু তবুও তাদের সকলের মনেই কিছু পারস্পরিক সাদৃশ্য আছে বলে ধারণা করা হয়। এই কাল্পনিকতা শুধু জাতীয়তাবাদেই সীমাবদ্ধ নয়। এমন সকল গোষ্ঠী যেখানে সকলের সাথে সকলের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই সেসকল গোষ্ঠীকেও অ্যান্ডারসন বলেছেন ‘Imagine Community’।

বর্তমান ভারতে যেখানে বিজেপি-আরএসএস একধরনের জাতীয়তাবাদের প্রচার চালাচ্ছে তখন ‘‘Imagine Community’-র তত্ত্বটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি ভারতীয় ঐতিহ্য রক্ষা ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নরেন্দ্র মোদীর সরকার কতখানি সচেষ্ট তা নিয়ে একখানি তথ্যচিত্র সম্প্রচার করেছে ডিডি নিউজ। সরকরের সম্প্রচারে সরকারের কীর্তি দেখানো হবে এটাই তো স্বাভাবিক! কিন্তু যা দেখানো হবে তা যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজনৈতিক নীতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়, সেক্ষেত্রে কতখানি তা আর ভারতীয় ঐতিহ্য থাকে? প্রশ্ন উঠবেই।

তথ্যচিত্রটির নাম, ‘ধরোহর ভারত কি পুনরুথান কি কাহানি’। ভারতীয় ঐতিহ্যের পুনরুথ্থানের গল্প, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশিষ্ট স্থানগুলিকেই তুলে ধরা হয়েছে এই তথ্যচিত্রে। এই তথ্যচিত্রটি গত সপ্তাহে ৩১ মিনিটের দু’টি পর্বে সম্প্রচারিত হয়েছে। সিরিজচির সঞ্চালিকা কাম্যা জানি এটিকে ‘নতুন ভারতে’র সফর হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন যা আখেরে ভারতীয় সংস্কৃতির পুনর্গঠনের সাক্ষী।

এই তথ্যচিত্রে বেশ কিছু প্রশ্ন তোলা হয়েছে এবং তার উত্তর খোঁজা হয়েছে। যেমন, আমাদের পূর্বপুরুষ কারা ছিলেন? আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উৎপত্তি কী? স্বাধীনতার হারিয়ে যাওয়া এবং সত্যিকারের নায়ক কারা ছিলেন? দেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি আমাদের গর্ব কীভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে?

হিন্দু পৌরাণিক ভিত্তি হিসেবে নিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতিকে আবর্তিত করা হয়েছে। তথ্যচিত্রের প্রথম অংশ চারচি যুগ (বা বিন্দু গ্রন্থে উল্লিখিত যুগ) এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত বর্তমান সময়ের সেই স্থানগুলির গর্ব ও ঐতিহ্য প্রচার করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই সমস্ত ঐতিহাসিক স্থানের সংস্কার বা উন্নয়ন ঘটিয়েছে মোদী সরকার, মূলত গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডেই এই স্থানগুলি রয়েছে।

ভৌগলিক এবং সমাজতাত্ত্বিক পরিধিতে বিশ্লেষণ করতে গিয়েও ভারতীয় ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বাদ পড়ে গিয়েছে দ্রাবিড়, আদিবাসী বা মুসলিমদের প্রভাব। সামান্য কিছু উল্লেখ ছাড়া তেমনভাবে আলোচিতই নয় ভারতের দ্রাবিড় সংস্কৃতি, আদিবাসীদের প্রভাব বা মুসলিমদের চর্চা। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে গুজরাতের কচ্ছ জেলার ধোলাভিরা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত এবং ভারতের ৪০ তম ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটিজ সাইট হিসাবে স্বীকৃতি।

ধোলাভিরার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সঞ্চালিকা নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা করেন কচ্ছ অঞ্চলকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। বিশেষ করে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদী এই অঞ্চলের জন্য ঠিক কী কী করেছেন তার বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন কাম্যা। সঞ্চালিকা বলছেন, ‘‘মানুষজন এই জায়গাটি সম্পর্কে জানত না, তবে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদী কচ্ছ এবং ধোলাভিরার চেহারা পরিবর্তন করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি এটিকে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন।’’

দ্বিতীয় পর্বে ছিল, করতারপুর সাহিব করিডোর। এই করিডোর দিয়েই তীর্থযাত্রীরা পাকিস্তানে প্রবেশ করে সেই স্থানটি দর্শন করতে পারেন যেখানে গুরু নানক তাঁর জীবনের শেষ ১৮ বছর কাটিয়েছিলেন এবং গুরু গ্রন্থ সাহেবের কিছু অধ্যায় লিখেছিলেন। ক্যামা জানিয়েছেন, শিখ সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এই করিডোর খুলে দেওয়ার, বিগত কয়েক দশক ধরে এই দাবি উপেক্ষা করা হয়েছিল।

তথ্যচিত্রটির প্রথম অংশে গুজরাতের সোমনাথ ও পাভাগড় মন্দিরে, মধ্যপ্রদেশের মহাকাল মন্দির, উত্তরপ্রদেশের কাশী বিশ্বনাথ ও অযোধ্যা মন্দির এবং উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ মন্দিরে সরকারের সংস্কারের ‘মহান’ এবং ‘বিশ্বমানের’ উদ্যোগের পর কী কী সুযোগ সুবিধা মিলেছে তা ফলাও করে বলা হয়েছে। নতুন দিল্লির পুরনো কেল্লার প্রাঙ্গণে জাদুঘরের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্ধার করা মূর্তি এবং প্রত্নবস্ত্তু রাখা রয়েছে।

তথ্যচিত্রের দ্বিতীয় অংশে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে যুক্ত স্থানগুলিকে দেখানো হয়েছে। অজ্ঞাত বিপ্লবীদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে তথ্যচিত্রটি। তবে সংগ্রামীদের তালিকায় আছেন মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, সর্দার প্যাটেল, বিআর আম্বেদকর এবং সাভারকরের মতো কয়েকজনই। মহিলারা কেউ নেই, অর্থাৎ মহিলাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনও ভূমিকাই নেই!

ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, আদৌ কি ভারতের পুনরুথ্থানের কাহিনিই বলছে এই তথ্যচিত্র, না কি স্পষ্টতই দেশে নরেন্দ্র মোদী সরকারের হাত ধরে এক নয়া বিজিপি’র উত্থানের কাহিনিকে প্রোথিত করা হচ্ছে জনমানসে? সরকারের কীর্তি প্রচারের লক্ষ্যে সিলেবাসে মুঘল পর্ব বাদের মতোই কি বাদ পড়ে যাচ্ছে না ‘অন্ত্যজ’ উত্থানের কাহিনি, আঞ্চলিক বিদ্রোহ, নারীদের ভূমিকার কাহিনি? আর এই জন্যই বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন রচিত ‘Imagined Communities : Reflections on the Origin and Spread of Nationalism‘ বইটির কথা খুব মনে পরে যাচ্ছে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#bjp politics, #Indian History, #Documentary, #dharohar bharat ki punarutthan ki kahani

আরো দেখুন