দেশ বিভাগে ফিরে যান

বিজেপি প্রশাসনের হঠকারিতায় মণিপুরে উগ্রবাদী সংগঠনগুলি ফের সক্রিয় হয়ে উঠছে?

May 6, 2023 | 4 min read

শুক্রবার নতুন করে হিংসার ঘটনা ঘটেছে মণিপুরে

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: শান্ত হওয়ার পরিবর্তে মণিপুরের পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে প্রশাসন দাবি করলেও, শুক্রবার রাতভর নতুন করে হিংসার ঘটনা ঘটেছে। রাজ্যটিতে কয়েক দিন ধরে চলা হিংসায় এখনও পর্যন্ত মৃত্যু ৫৪ জন দাঁড়িয়েছে।

মণিপুর রাজ্য পুলিশ সংবাদসংস্থা এএফপিকে জানায়, শুক্রবার রাতে নতুন করে হিংসার ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে পিটিআই বলেছে, রাজ্যের রাজধানী ইম্ফলের হাসপাতালগুলোর মর্গে এবং আরও দক্ষিণে চূড়াচাঁদপুর জেলার হাসপাতালের মর্গগুলোতে মোট ৫৪টি মরদেহ এসেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তার বক্তব্য উল্লেখ করে পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়, চূড়াচাঁদুপর জেলার হাসপাতালের মর্গে ১৬টি মরদেহ ও পূর্ব ইম্ফল জেলার জওহরলাল নেহরু ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সে ১৫টি মরদেহ রয়েছে। পশ্চিম ইম্ফল জেলার লেমফেলের দ্য রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সে রয়েছে ২৩টি মরদেহ।

মণিপুর পুলিশের ডিজি পি ডুঞ্জেল গতকাল শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নিরাপত্তা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনছে। সেনাবাহিনীও ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পার্শ্ববর্তী রাজ্য নাগাল্যান্ডের একটি সেনা ইউনিট জনিয়েছে, মণিপুর থেকে এই সেনা চত্বরে ১৩ হাজার মানুষ আশ্রয় চেয়েছে।

শুক্রবার গভীর রাতেও মণিপুরের চূড়াচাঁদপুরে গুলি করে খুন করা হয়েছে বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসা এক সিআরপিএফ কমান্ডোকে। রাজধানী ইম্ফলে হিংসার বলি হয়েছেন ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের এক আয়কর আধিকারিক।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যটিতে ৩৫৫ ধারা জারি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

অলিম্পিক্স পদকজয়ী বক্সার মেরি কমকে পর্যন্ত বলতে হচ্ছে, “আমার রাজ্য জ্বলছে। সকলে মিলে মণিপুরকে রক্ষা করুন”।

কিন্তু কেন এই হিংসা?

মণিপুর-হিংসার কারণ অনুসন্ধানে সে রাজ্যের জনতত্ত্ব বা ডেমোগ্রাফির দিকে নজর দিতে হবে। জনসংখ্যার নিরিখে মেইতেই সম্প্রদায়ই সে রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই মেইতেই গোষ্ঠীর তফসিলি জনজাতি (এসটি) তকমার দাবিতে আন্দোলন শুরু করার পরেই সে রাজ্যে হিংসার সূত্রপাত।

মেইতেইদের তফসিলি জনজাতি তকমা পাওয়ার বিরোধিতা করছে রাজ্যের অন্য তফসিলি সম্প্রদায়গুলি। রাজ্যে প্রায় ৩৪টি স্বীকৃত তফসিলি সম্প্রদায় থাকলেও, এদের মধ্যে প্রভাবে এবং জনসংখ্যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কুকিরা।

রাজ্যের তফসিলি সম্প্রদায়গুলির দাবি, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিসাবে এমনিতেই বহু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষরা। তাই তাদের আর আলাদা করে তফসিলি জনজাতির তকমা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

অন্য দিকে, মেইতেইদের দাবি, রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও তাদের অস্তিত্বসঙ্কট দেখা দিয়েছে। তার প্রমাণ হিসাবে তারা ২০১১ সালের জনসুমারীর পরিসংখ্যানকে খাড়া করছে।

ওই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ১৯৫১ সালে মণিপুরে ৫৯ শতাংশ মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষ থাকলেও ২০১১ সালে কমতে কমতে তা ৪৪ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। তা ছাড়া মণিপুর উপত্যকায় জনজাতি বিশেষত কুকিদের বিরুদ্ধে জায়গা জমি দখল করার অভিযোগ তুলেছে তারা।

মায়ানমারের জুন্টা সরকারের তাড়া খেয়ে বহু অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মণিপুরে এসে জায়গাজমি দখল করছে বলেও মেইতেইদের অভিযোগ। প্রসঙ্গত, মণিপুরে সংবিধানের ৩৭১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পাহাড়ি অঞ্চলে শুধু তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষই বাড়ি করতে পারেন।

রাজ্যের নানা পাহাড়ি অঞ্চলে জনজাতি সম্প্রদায়গুলি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও, মূলত রাজধানী শিলং এবং সন্নিহিত উপত্যকায় বসবাস করে মেইতেইরা। রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হলেও মেইতেইরা রাজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ অঞ্চলে বসবাস করেন।

এই হিংসার প্রেক্ষাপট অবশ্য রচিত হয়েছিল অনেক আগেই। মণিপুরের তফসিলি জনজাতি সম্প্রদায়গুলির অধিকাংশই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। অন্য দিকে, মেইতেইদের অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

তবে এই হিংসার নিবিড় পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, এটি নিছক হিন্দু বনাম খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংঘাতের বিষয় নয়। বরং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির যে সাধারণ সমস্যাগুলি রয়েছে, মণিপুরের এই সমস্যাও তার ব্যতিক্রম নয়।

কিছু দিন আগেই অবৈধ উপায়ে জমি দখলের অভিযোগে পাহাড়ি অঞ্চলে তিনটি গির্জা ভেঙে দেয় মণিপুর সরকার। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয় কুকি-সহ অন্য তফসিলি জনগোষ্ঠীগুলি।

তারও আগে অবৈধ পোস্ত চাষের অভিযোগে পাহাড়ি অঞ্চলগুলিতে অভিযান চালায় সরকারের বিশেষ বাহিনী। কুকিদের অভিযোগ, মেইতেইদের পাহাড়ি অঞ্চলে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার।

তারও আগে অবৈধ পোস্ত চাষের অভিযোগে পাহাড়ি অঞ্চলগুলিতে অভিযান চালায় সরকারের বিশেষ বাহিনী। কুকিদের অভিযোগ, মেইতেইদের পাহাড়ি অঞ্চলে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার।

সম্প্রতি মণিপুর হাই কোর্ট মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছে। এর পরেই জনজাতি সংগঠনগুলি বুধবার থেকে তার বিরোধিতায় পথে নামে।

উচ্চ আদালতের নির্দেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় আদালত অবমাননার দায়ে তফসিলি ছাত্র সংগঠন (এটিএসইউএম)-এর সভাপতিকে শোকজ় নোটিস পাঠায় মণিপুর হাই কোর্ট। তার পরই তফসিলি গোষ্ঠীগুলি দাবি করে, হাই কোর্ট মেইতেইদের কথায় কাজ করছে।

বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাসের ঘটনা দেখা গিয়েছিল পড়শি রাজ্য অসমেও। সে রাজ্যে অসমিয়ারা দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরা তাদের জমি-জীবিকা কেড়ে নিচ্ছে।

মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ নিজেও মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষ। এর আগে কুকি, অঙ্গামি, লুসাই, নাগা, থাড়োয়াসের মতো তফসিলি সম্প্রদায়গুলির আস্থা অর্জনে ইম্ফলের বাইরে বেরিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে মন্ত্রিসভার বৈঠক করতেন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি নাকি তাঁর সেই উদ্যোগে ছেদ পড়ে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তফসিলি জনগোষ্ঠী এবং মেইতেইদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ ফেরাতে না পারলে, মণিপুরের হিংসায় লাগাম পরানো যাবে না।

তবে মণিপুরের সাধারণ মানুষের বক্তব্য, পরিস্থিতি সরকার বা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নেই। পশ্চিম মণিপুরের বিজেপির জনজাতি সমাজের এমএলএ ভুংজাগিন ভাল্টে ইম্ফলে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসার জন্য দিল্লিতে নেওয়া হয়েছে। কংগ্রেসের তরফে জানানো হয়েছে, তাদেরও একাধিক নেতা আক্রান্ত হয়েছেন।

জানা যাচ্ছে, যে অঞ্চলে যারা শক্তিশালী, তারা সেই অঞ্চল পাহারা দিচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলে যাতায়াতের রাস্তাঘাট বন্ধ। এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, মেইতেই অধ্যুষিত এলাকা বিশেষ করে ইম্ফলে কুকিসহ অন্যান্য উপজাতির মানুষের নিরাপত্তা এবং উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় মেইতেইদের রক্ষা করা।

৩০টি জাতি-গোষ্ঠী রয়েছে এমন উপজাতীয় সমাজের বক্তব্য হচ্ছে, মণিপুর সরকার মেইতেই সমাজের হয়ে কাজ করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুকি সম্প্রদায়ের এক স্কুলশিক্ষক বলেন, উপজাতি গোষ্ঠীগুলো বেশ পিছিয়ে রয়েছে। হিন্দু মেইতেইরা যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। তাদের আরও বাড়তি সুযোগ–সুবিধা দিতে তাদের সংরক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে সরকার, যা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। প্রধানত কুকি, নাগা, পেইতেই, যমিসহ প্রধান প্রধান পার্বত্য উপজাতি জনগোষ্ঠী মেইতেইদের আদিবাসী সংরক্ষণের বিরোধিতা করছে।

মণিপুরের সঙ্গে মায়ানমারের দীর্ঘ সীমান্ত থাকায় মায়ানমারের অংশে চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করা হয়েছে বলে ওই দেশের সামরিক গোয়েন্দার একটি সূত্র সংবাদসংস্থাকে জানিয়েছে। সব মিলিয়ে মণিপুরের অবস্থা উদ্বেগজনক। বিরোধীদের অভিযোগ উত্তরপূর্ব ভারতের এই রাজ্যগুলির সংবেদনশীল। ফলে বেজেপি সরকারকে আরও সতর্কভাবে পদক্ষেক করতে হতো। এই রাজ্যগুলিতে দীর্ঘসময় ধরে বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রশাসনকে। ফের তারা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Manipur

আরো দেখুন