বৈশাখ মাসে পালিত হয় হরিষ মঙ্গলচন্ডীর ব্রত, জেনে নিন এই ব্রত প্রচলনের কাহিনী
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি:
‘হরিষ মঙ্গলচন্ডীর ব্রত যেই নারি করে।
সব দুঃখ চোখের জল মা তার হরে’
বৈশাখ মাসের প্রতি মঙ্গলবার হরিষ মঙ্গলচন্ডীর ব্রত পালন করা হয়। সধবা ও বিধবা মেয়েরাই এই ব্রত করেন। নানান রকম ফুল, তুলসী পাতা, দূর্বা, আলোচাল, কাঁঠালি কলা, মালা, ঘট, আম পাতা ও নৈবেদ্য দিয়ে ব্রতীরা ব্রত পালন করেন।
কোনও এক গ্রামের এক গয়লার বউ ও এক ব্রাহ্মণীর খুব বন্ধুত্ব ছিল। প্রত্যেক বছর বৈশাখ মাসে ব্রাহ্মণী হরিশ মঙ্গলচন্ডীর ব্রত করতেন, আর গয়লা বউ, সেই ব্রত পালন করা দেখত। দেখতে দেখতে গয়লা বউয়ের ব্রত করার ইচ্ছে হলে সে ব্রাহ্মণীকে জিজ্ঞাসা করল, এই ব্রত করলে কী ফল হয়। ব্রাহ্মণী জানাল, এই ব্রত করলে জীবনে কারোর চোখের জল পড়ে না। ব্রতীর সারা জীবন আনন্দে কাটে। এই কথা শুনে গয়লার বউয়ের খুব আনন্দ হল। ব্রাহ্মণীকে বলল সেও ব্রত করতে চায়। ব্রাহ্মণী গয়লার বউকে বোঝালেন বললেন ব্রত করা খুবই কঠিন। কিন্তু গয়লা বউ কোন কথাই শুনতে চাইল না। শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণী বাধ্য হয়ে তাঁকে ব্রতের সব কথা বলে দিলেন, এরপর বৈশাখ মাস পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গয়লা বউও ব্রত করতে আরম্ভ করলেন।
দুটো মঙ্গলবার ব্রত পালন করার পরই, মা মঙ্গলচন্ডীর তার উপর দয়া হল আর সঙ্গে সঙ্গে ঐশ্বর্য্য সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠল গয়লা বউয়ের সংসার। গয়লা বউ খুবই গরীব ছিল। এতো সম্পদ দেখে সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে আর সহ্য করতে পারল না তার অবস্থার পরিবর্তন।
এখন তার কাঁদার ইচ্ছে হতে লাগল। কিন্তু যার এত ধন সম্পদ, তার কান্না আসবে কেমন করে? শেষে গয়লা বউ ব্রাহ্মণীকে বলল, ‘সই, আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না ইচ্ছে হচ্ছে খুব খানিকটা কাঁদি। তুমি আমাকে বলে দাও সই, কি করলে আমি কিছুটা কাঁদতে পারি?’ গয়লা বউয়ের কথা শুনে ব্রাহ্মণী একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি বললেন, ‘সে কি সই, তুমি কাঁদবে কেন? এখন সুখের সংসার হয়েছে, এত আনন্দ ভোগ করছ এখন কেউ কাঁদতে চায় নাকি? এটা হরিষ মঙ্গলচন্ডী ব্রতর ফল। সে বললে ‘আমি কাঁদতে না পারলে আমি বাঁচবো না সই! তুমি আমাকে বলে দাও কি করলে আমার কান্না পাবে।’ ব্রাহ্মণী খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কি বলবেন কিছু ভেবে পেলেন না।
একটু দূরে একটা চাষের ক্ষেত চোখে পড়ল তার। সেখানে অনেকগুলো লাউ আর কুমড়ো ছিল। ব্রাহ্মণী গয়লা বউকে বললেন, ‘যাও সই, ওই ক্ষেতটা দেখা যাচ্ছে, খুব লাউ আর কুমড়ো ফলেছে ওখানে-ওই ক্ষেতে গিয়ে লাউ কুমড়ো গুলোকে তুলে নাও আর গাছগুলোকে একেবারে লন্ডভন্ড করে দাও। তাহলেই চাষিরা খুব রেগে গিয়ে তোমাকে খুব গালমন্দ দেবে, আর তাহলেই তোমার কান্না আসবে।’ সইয়ের কথা শুনে, গয়লা বউ তখনই ছুটে গেল সেই ক্ষেতের ভিতর ঢুকে গাছগুলো সব ছিড়ে খুঁড়ে দিয়ে চলে এলো। কিন্তু এতে আসল কাজ কিছু হল না বরং ফলটা উল্টো হল মা মঙ্গলচন্ডীর দয়ায় আবার গাছগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠলো আর চাষিদের খুব আনন্দ হল। চাষিরা তখনই সেই গয়লা বউয়ের কাছে এসে বলল, ‘মা! তোমার হাতের ছোঁয়া লেগে আমাদের আধমরা গাছগুলো আবার সতেজ হয়ে উঠেছে। তুমি মা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী।’ এরপর ব্রাহ্মণী বললেন, ‘দেখো সই, ওই দূরে পাহাড়ের ধারে রাজার হাতিটা মরে পড়ে আছে তুমি ওখানে গিয়ে হাতিটার গলা জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করো। তাহলে রাজার লোকেরা ভাববে যে তুমি হাতির দাঁতে চুরি করতে এসেছ, তখন তারা তোমায় খুব মারধর করবে আর তুমিও খুব কাঁদবার সুযোগ পাবে।’ কিন্তু এবারেও কোন কাজ হল না। গয়লা বউ হাতিটার গায়ে হাত দিতেই হাতিটা বেঁচে উঠল।
রাজার লোকেরা একেবারে অবাক হয়ে গেল, সব শুনে রাজা খুব খুশি হলেন আর গোয়ালা বউকে ডেকে তাকে অনেক ধনরত্ন করে পুরস্কার হিসেবে দিলেন। এবারেও কোন কাজ হলোনা দেখে ব্রাহ্মণী বুঝলেন যে, মা মঙ্গলচন্ডীর দয়াতে এবারও তাই হয়েছে। ব্রাহ্মণী তখন গয়লা বউকে আবারো একটা পরিকল্পনা বললেন, ‘দেখো সই, এক কাজ করো, কতগুলো বিষের নাড়ু তৈরি করে
তোমার মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দাও। তাহলে ওই নাড়ুগুলো খেয়ে তারা সবাই মরে যাবে আর তুমিও তখন কাঁদতে পারবে।’ সইয়ের কথামতো গয়লা বউ তাই করল, কিন্তু মা মঙ্গলচন্ডীর দয়ায় বিষের নাড়ু গুলো সব অমৃত হয়ে গেল। এতেও যখন কাজ হলো না তখন ব্রাহ্মণী গয়লা বউকে বললেন যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না তখন তুমি হরিষ মঙ্গলচন্ডী ব্রত করা ছেড়ে দাও সই।’
গয়লা বউ মঙ্গলচন্ডীর ব্রত করা ছেড়ে দিল। ফলে মা মঙ্গলচন্ডী খুব রেগে গেল। মা মঙ্গল চন্ডী গয়লা বউয়ের উপর রেগে গিয়ে তার স্বামী পুত্র, দাস-দাসী, হাতি ঘোড়া ছিল সকলকে কেড়ে নিলেন এবং যত ধনরত্ন ছিল সবই কেড়ে নিলেন। গয়লা বউ স্বামী পুত্র আত্মীয়-স্বজনকে হারিয়ে কাঁদতে লাগলেন। এখন তার দিনরাত কান্না ছাড়া আর কিছুই নেই। এতো কান্না সহ্য করতে না পেরে শেষে ব্রাহ্মনীর কাছে গিয়ে বলল, ‘সই আমি আর কাঁদতে পারছি না আমি আর সহ্য করতে পারছি না যেমন করে পারো আমার কান্না থামিয়ে দাও।’
ব্রাহ্মণী বললেন ‘তুমি তো কাঁদতে চেয়েছিলে, এখন কান্না থামাতে বললে কি হবে। যাক যা হবার হয়ে গেছে, এখন বাড়ি গিয়ে মরাগুলোকে খুব সাবধানে রেখে দাও। সামনের মঙ্গলবার থেকে আবার মা মঙ্গলচন্ডীর হরিষ মঙ্গলচন্ডীর ব্রত করা আরম্ভ কর। সইয়ের কথা শুনে গয়লা বউ বাড়ি ফিরে এসে মা মঙ্গলচন্ডীর স্তব করতে লাগলো। তারপর মঙ্গলবার আসতেই সে মা মঙ্গলচন্ডীর হরিশ মঙ্গলচন্ডীর ব্রত করা শুরু করল। মাকে ডাকতে লাগল, এমন সময় সে শুনতে পেল কে যেন বলছে- ‘আর এমন কাজ করিসনি, যা তোর আর কোন ভয় নেই এই ঘটের জল মরা গুলোর গায়ে ছিটিয়ে দে তাহলেই সবাই বেঁচে উঠবে।’
ঘটের জল ছিটিয়ে দেওয়ার ফলে গয়লা বউয়ের সবাই মা মঙ্গলচন্ডীর দয়ায় বেঁচে উঠল আর তার আগের অবস্থা ফিরে এল। গয়লা বউ তখন খুব শুদ্ধচারে মা মঙ্গলচন্ডীর ঘটটি তুলে রেখে ছুটে গেল ব্রাহ্মণীর কাছে তাকে সব কথা জানাল। এইভাবেই প্রচলিত হল ব্রত।