১৩৪ বছরে শকুন্তলা রক্ষা কালীর পুজো, প্রতি বৈশাখে পূজিত হন দেবী
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ১৩৪ বছরে পড়ল শকুন্তলা রক্ষা কালীর পুজো। হুগলির কোন্নগরে বিরাজ করেন শ্রী শ্রী শকুন্তলা রক্ষাকালী মা। শতাব্দী প্রাচীন পুজো শুরু করে হয়েছিল ডাকাতদের হাতে। মায়ের কাছে নরবলি দিয়েই ডাকাতি শুরু করতে যেত ডাকাতের দল। সমগ্র কোন্নগরবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা মায়ের পুজোর জন্য।
প্রতিবছর বৈশাখ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের তৃতীয়া বা তারপরে যে শনিবার আসে, সেদিনই মায়ের বাৎসরিক পুজো হয়। পুজোর দিন হাজার হাজার মানুষের ভিড় করে, পুজোকে কেন্দ্র করে মন্দির সংলগ্ন মাঠে বড় মেলা বসে। মস্ত অশ্বত্থ গাছের নীচে ছিল মায়ের থান। গাছের ওপরে বাস করত শকুনের দল, তাই থানের নাম শকুন্তলা মায়ের থান, সেই থেকে মায়ের নামও শকুন্তলা রক্ষাকালী মা। অমাবস্যার রাতে ডাকাত দল এসে পুজো দিয়ে যেত, ছাগবলি, মহিষবলি, কখনও কখনও বা নরবলিও দিত মনস্কামনা পূরণের জন্য। পুজো শেষে গায়ে রেড়ীর তেল মেখে হাতে লাঠি অথবা কাটারি নিয়ে ডাকাতরা বেরিয়ে পড়ত ডাকাতিতে।
সেই কাল থেকেই কথিত মা সূর্যের মুখ দেখেন না। তাই মূর্তি বানানো হয় সূর্যাস্তের পর, দ্বিতীয় প্রহর শেষ হলে পুজো শুরু আর সূর্যোদয়ের আগেই মায়ের বিসর্জন দেওয়া হয়। স্থানীদের বিশ্বাস মা খুব জাগ্রত। মায়ের মূর্তি গঠনেও তারতম্য আছে, মাটিতে দুধ ও দেশী মদ মিশিয়ে মূর্তি তৈরি হয়। পুজোর আগের দিন রাত ১২ টার পর থেকেই মানুষের ভিড় শুরু হয়। গঙ্গায় ডুব দিয়ে জল নিয়ে এসে বেদীতে জল ঢালা চলে সারা রাতজুড়ে। মায়ের সাজ শেষ করে শ্রী বাদল পালের গোলা থেকে মাকে মন্দিরের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যায় বরণ করে বেদীতে বসিয়ে পূজা শুরু হয়। তারপর পশু বলি শুরু হয়। অনেকের মানত থাকে মায়ের কাছে আর সেই মানত পশুবলির মাধ্যমে পূর্ণ করেন। সারারাত কয়েকশ বলি হওয়ার পর শুরু হয় যজ্ঞ আহুতি। ভোর ৫ টায় সূর্য ওঠার আগে মায়ের প্রায় ১০০ ভরি সোনার গহনা খোলা হয়ে গেলে বিসর্জন দেওয়া হয়। আবার শুরু হয় এক বছরের প্রতীক্ষা।
এই পুজো সার্বজনীন হয়ে ওঠাও এক মস্ত কাহিনী। আধুনিক রূপে কোন্নগরের শকুন্তলা কালী মাতার পুজো শুরু হয় ১২৯৭ বঙ্গাব্দে। এখন যেখানে মায়ের মন্দির, সেইখানেই ১২৯৭ বঙ্গাব্দে বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষে শনিবার দিন প্রথম পুজো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন কোন্নগরের ওই স্থানের বাসিন্দারা যৌথভাবে একটি বারোয়ারী পুজো চালু করেছিলেন। আজ পর্যন্ত মায়ের পুজো ওই বারোয়ারীভাবেই হয়ে আসছে।
লোকমুখে শোনা যায়, একদিন বাঞ্চারাম মিত্র লেনের চক্রবর্তী বাড়ির দেবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পৌরহিত্যের কাজ সেরে হেঁটে ফিরছিলেন। গড়ের খানার ওপর দিয়ে আসার সময়, তাঁর বাড়ির রাস্তা বাঞ্চারাম মিত্র লেনে ঢোকার আগে তিনি এলোকেশী শ্যামলা এক অপরূপা নারী মূর্তিকে হটাৎ দেখতে পান। ওই নারী তাঁর পথ আটকে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে তখনই তিনি ওই নারী মূর্তির অঙ্গ থেকে জ্যোতি নির্গত হতে দেখেন। চমকে ওঠেন। সাময়িক ঘোর কাটিয়ে উঠেই তিনি ওই নারীমূর্তিকে বলেন, “তুমি কে মা? কেন এইভাবে আমার পথ আটকে দাঁড়ালে কেন?” সেই অপরূপা নারী কোন উত্তর না দিয়ে রহস্যের হাসি হেসে কিছুটা দূরে গিয়ে মিলিয়ে যান। এরপরে আবার স্বপ্নে ওই নারীমূর্তিকে তিনি ওই একই জায়গায় মিলিয়ে যেতে দেখেন। পরের দিন তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের ডেকে তাঁর স্বপ্নের কথা বললে, সবাই মিলে স্থির করে ওই নারী মূর্তি যে জায়গায় মিলিয়ে গিয়েছে। ওখানেই স্বপ্নে দেখা রূপের আদলে মাটির মূর্তি গড়ে পুজো করা হবে।
প্রথম বছর পুজো ঘটেই হয়েছিল। তারপর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই প্রচুর ভক্তর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ায় মায়ের মাহাত্ম্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, মন্দির তৈরি হয়। আজও কোন্নগরের মানুষ দেবী আরাধনা করে চলেছে।