কর্ণাটকে ভরাডুবির পরও ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ প্রচারে মরিয়া বিজেপি
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ২০১৪ সালের পর নরেন্দ্র মোদীর ক্যারিশমায় একের পর এক নির্বাচনের বৈতরণী পার হয়েছে বিজেপি। সঙ্গে বর্তমান ভারতীয় রাজনীতির ‘চানক্য’ অমিত শাহর কৌশলী চাল। কিন্তু ইদানিং যেন এই ফর্মুলা বিজেপি’র কাজে আসছে না। হিমাচল প্রদেশের পরে ছ’মাসের মধ্যে কর্নাটকে হারতে হল তাদের। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে যা নিঃসন্দেহে কপালে ভাঁজ ফেলেছে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের।
এখন প্রমাণ হয়ে গিয়েছে আদৌ অজেয় নন নরেন্দ্র মোদী। কর্নাটক হাতছাড়া হওয়ার পর দক্ষিণ ভারত এখন বিজেপি-মুক্ত। এরফলে দেশে বিজেপি শাসিত রাজ্যের সংখ্যা ১৯ থেকে কমে ১৬-তে এসে ঠেকেছে। গেরুয়া শিবিরের সবচেয়ে ভাল উপস্থিতি এখন উত্তর-পূর্ব ভারতে যেখানে আবার ২০১৬- আগে দলের কার্যত অস্তিত্বই ছিল না। দেশের বাকি অংশে পদ্ম শিবিরের উপস্থিতি ক্রমশ ফিকে হচ্ছে।
তবে নির্বাচনে হেরেও সরকার গড়াতে তারা নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেছে অপারেশন লোটাস অর্থাৎ দল ভাঙানোর খেলায়। সদ্য হাতছাড়া কর্নাটক তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাড়ে তিন বছর আগে কংগ্রেস বিধায়কদের ভাঙিয়ে ওই রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছিল তারা। বিধানসভা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ২০১৮-র ভোটে সরকার গড়েছিল জেডিএস-কংগ্রেস জোট। সেই সরকারকে টিকতে পারেনি অপারেশন লোটাসের ধাক্কায়। এইভাবে গত বছর মহারাষ্টে পদ্ম শিবির ফের ক্ষমতায় ফেরে শিবসেনাকে ভাঙিয়ে। তার আগে মণিপুর, মধ্যপ্রদেশে একইভাবে ক্ষমতায় এসেছিল গেরুয়া শিবির। কর্নাটকের আগে ভোট হয়েছে ত্রিপুরা, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে। এই তিন রাজ্যের মধ্যে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে একমাত্র ত্রিপুরায়। মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডেও তারা সরকারে আছে। যদিও ভোটে শরিক দলের সঙ্গে লড়াই করে একক শক্তিতে সরকার গড়ার পরিকল্পনা করেছিল গেরুয়া শিবির। ভোটের পর সফল হয়নি তাদের অপারেশন লোটাস-ও।
২০১৮-তে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়-সহ পাঁচ রাজ্যে ভোট হয়। বিজেপি একটিতেও জিততে পারেনি। এরমধ্যে মধ্যপ্রদেশে এক বছরের মাথায় কংগ্রেসের বিধায়ক ভাঙিয়ে ফের ক্ষমতা দখল করে পদ্ম শিবির। মধ্যপ্রদেশে তারা কংগ্রেস নেতা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে পাশে পেয়ে গিয়েছিল।
‘অপারেশন লোটাস’কে একদম শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বিজেপি। যার প্রধান কারিগর ছিলেন অমিত শাহ। কিন্তু বর্তমানে বিজেপি’র এই কৌশল আর ঠিকভাবে কাজ করছে না। দলবদলু বিধায়করা কর্ণাটক বিধানসভায় ফিরতে পারছেন না। ‘অপারেশন লোটাসে’ দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ২০১৯ সালে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৪ জন বিধায়ক। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়ার দল জেডিএস ছেড়ে তিনজন। অর্থাৎ মোট ১৭ জন দল পাল্টেছিলেন। যার জেরে পতন হয়েছিল কং-জেডিএস সরকারের। ক্ষমতা দখল করেছিল বিজেপি। এবার ভোটে ওই দলবদলু বিধায়কদের মধ্যে টিকিট পেয়েছিলেন ১০ জন। বিজেপি দিয়েছিল ন’জনকে। এনসিপি একজনকে। হেরেছেন সবাই। যাঁর মধ্যে রয়েছেন রাজ্যের বিদায়ী স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে সুধাকরও।
কর্ণাটকে এবার বিজেপির হারকে ‘মোদীর পরাজয়’ বলে সরাসরি চিহ্নিত করার যথেষ্ট কারণও আছে। নির্বাচন ঘোষণার আগে থেকে প্রচার শেষ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বারবার ওই রাজ্যে গেছেন। শেষ সাত দিনে ২১টি জনসভা করেছেন, রোড শো করেছেন চারটি। পোস্টার, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, কাট আউটে স্রেফ তাঁরই মুখ প্রাধান্য পেয়েছে। শুধু তা–ই নয়, শীর্ষ নেতারা পর্যন্ত জনসভায় প্রার্থীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও মোদীর নামে ভোট চেয়েছেন। জনতাকে বলেছেন, তাঁরা যেন প্রতিটি ভোট মোদীকে দেন। এমন ‘মোদীময়’ প্রচার সত্ত্বেও এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার পর স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই ফলকে ‘মোদীর পরাজয়’ বলেই বর্ণনা করছেন।
যদিও ভোটে বিজেপির ভরাডুবির দায় থেকে ইতিমধ্যেই তাঁকে মুক্তি দিয়েছে দল। সব দোষ চাপানো হয়েছে, বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই, রাজ্য বিজেপির সভাপতি নলিনকুমার কাতিল, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিএস ইয়েদুরাপ্পাদের ঘাড়ে। বরং লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদীর ‘ধাক্কা খাওয়া ভাবমূর্তি’ মেরামতে অতিসক্রিয় হচ্ছে বিজেপি। আর তার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে মোদী সরকারের নবম বর্ষপূর্তিকে।
এমনিতেই চলতি বছরের শেষেই আরও অন্তত পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন। এর মধ্যে রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে এখন ক্ষমতায় কংগ্রেস। মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় বিজেপি। তেলেঙ্গানায় এখন রয়েছে কেসিআরের ভারত রাষ্ট্র সমিতি, মিজোরামে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট। এ বছর ভোট হতে পারে কাশ্মীরেও। সেটা অবশ্য আপাতত রাষ্ট্রপতি শাসিত। লোকসভা নির্বাচনের আগে কর্ণাটকে বিজেপির ভরাডুবি দেশের রাজনীতিতে নতুন মোড় বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, এর প্রভাব পরবর্তী পাঁচ রাজ্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও জম্মু কাশ্মীর ছাড়াও লোকসভা নির্বাচনে পড়তে বাধ্য। বিশেষ করে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় নিয়ে চিন্তিত বিজেপি। এখন আর কেবল ‘অপারেশন লোটাস’-এর উপর ভরসা রাখতে পারছেন না বিজেপি শীর্ষ নেতারা। কারণ, হিমাচলপ্রদেশ, কর্ণাটকে প্রমান হয়ে গেছে ‘অপারেশন লোটাস’ এখন বুমেরাং হয়ে ফিরছে বিজেপি’র দিকে।
ফলে আগামী ৩০ মে মোদী সরকারের নবম বর্ষপূর্তিতে কেন্দ্রের ‘সাফল্য’ প্রচারের জন্য দেশ জুড়ে প্রচারসভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত, অর্থাৎ পরবর্তী এক মাস ধরে চলবে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার কর্মসূচি। দেশ জুড়ে ৩৯৬টি লোকসভা আসনে জনসভায় অংশ নেবেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিজেপির জাতীয় স্তরের নেতারা। মোদী সরকারের ন’বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে জনসভা ৩০ মে প্রধানমন্ত্রী মোদী স্বয়ং তাঁর সরকারের বর্ষপূর্তিতে প্রচার কর্মসূচির সূচনা করবে। এই দিন একটি সমাবেশে যোগ দেবেন তিনি। পরের দিনও প্রচার কর্মসূচি রয়েছে তাঁর। কারণ, বিজেপি’র বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখনও মনে করে ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।’