কর্ণাটকের পরাজয়ের দাগ যেন মোদীর গায়ে না লাগে! হাড়িকাঠে BJP-র রাজ্য নেতৃত্ব
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: হিমাচল প্রদেশের পরে ছ’মাসের মধ্যে কর্নাটকে হারতে হল বিজেপিকে। কর্ণাটকে এবার বিজেপির হারকে ‘মোদীর পরাজয়’ বলে সরাসরি চিহ্নিত করছেন অনেকেই। এর যথেষ্ট কারণও আছে। নির্বাচন ঘোষণার আগে থেকে প্রচার শেষ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বারবার ওই রাজ্যে গেছেন। শেষ সাত দিনে ২১টি জনসভা করেছেন, রোড শো করেছেন চারটি। পোস্টার, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, কাট আউটে স্রেফ তাঁরই মুখ প্রাধান্য পেয়েছে। শুধু তা–ই নয়, শীর্ষ নেতারা পর্যন্ত জনসভায় প্রার্থীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও মোদীর নামে ভোট চেয়েছেন। জনতাকে বলেছেন, তাঁরা যেন প্রতিটি ভোট মোদীকে দেন। এমন ‘মোদীময়’ প্রচার সত্ত্বেও এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার পর স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই ফলকে ‘মোদীর পরাজয়’ বলেই বর্ণনা করছেন।
কিন্তু কর্ণাটকে বিধানসভা ভোটে দলের বিপর্যয়ের পর প্রধানমন্ত্রী মোদীর উপরে হারের দায় চাপানো বিরোধী শিবিরকে এবার পাল্টা আক্রমণে বিজেপি নেতৃত্ব। ইতিমধ্যে কর্ণাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই জানিয়ে দিয়েছেন, ওই পরাজয়ের জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া। ঠিক কোন কারণগুলির জন্য দল হেরেছে, তা পর্যালোচনা করে দেখা হবে বলে অবশ্য আগেই জানিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু রাজনৈতিক মহলের প্রশ্ন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া আঁচ করেই তো মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তন করা হয়েছিল। আর যাঁকে নতুন মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেই বাসবারাজ বোম্মাই বলছেন, “এই হারের দায় মোদির নয়। তিনি তো শুধু কর্ণাটকে ভোটের প্রচারে এসেছিলেন। তিনি গোটা দেশের নেতা।’’
প্রধানমন্ত্রীর দিকে যাতে আঙুল না ওঠে সে জন্য হারের জন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছে বাসবরাজ বোম্মাইকে। বছর দু’য়েক প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়ার কারণে ইয়েদুরাপ্পাকে সরিয়ে বোম্মাইকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। এখন ভোটের ফলের পরে সেই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। দলের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী বদলের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কিন্তু বি এস ইয়েদুরাপ্পার পরিবর্তে যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয় সেই বাসবরাজ বোম্মাই উপযুক্ত প্রার্থী ছিলেন না বলেই এখন মনে করছে দলের একাংশ। তাদের দাবি, মূলত বোম্মাইয়ের প্রশাসন চালানোর প্রশ্নে অনভিজ্ঞতার কারণে দুর্নীতির লাগামছাড়া বাড়বাড়ন্ত হয়। মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও কাটমানি খাওয়ার অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কড়া সাহস দেখাতে ব্যর্থ হন বোম্মাই। যা জনমানসে বিজেপির বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সম্ভবত মানুষের সেই ক্ষোভের কারণেই চলতি নির্বাচনে বোম্মাই মন্ত্রিসভার ১২ জন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বি সি নাগেশ ছিলেন হিজাব নীতির অন্যতম কারিগর। হারের মুখ দেখতে হয়েছে তাঁকে।
দলের মুখপাত্ররা টেলিভিশন চ্যানেলের বক্তব্যে বারে বারে দাবি করতে থাকেন, মোদীজি, অমিতজি না থাকলে ফল আরও খারাপ হতে পারত। তবে এটা কথার কথা। মোদী-শাহের জমানায় বিজেপিতে পুরস্কার-তিরস্কার নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। ভোটের পরই পরাজয়ের দায় সাংগঠনিকভাবে এক বা একাধিক নেতার উপর চাপানো হয়। যদিও সেটা আসলে মোদী ও শাহকে রক্ষার কৌশল বলে দলের অনেকেই মনে করেন।
যেমন ২০২১-এ বাংলায় ঘটেছিল। সে সময় ভোটের প্রচারে তাঁরা রাজ্যবাসী এবং দলের কর্মী-সমর্থকদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন দু’ শো আসন নিয়ে দল ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু ৭৭ আসনে ঠেকে গিয়েছিল বিজেপি। কর্নাটকে আবার দলের শুধু ক্ষমতা হাতছাড়া হয়েছে তাই-ই নয়, আসন প্রাপ্তিতে সেঞ্চুরিও করতে পারেনি পদ্ম-শিবির। থমকে গিয়েছে ৬৬-তে।
বাংলায় পরাজয়ের দায় চাপিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে। কর্নাটকেও সরানো হচ্ছে ওই পদে থাকা নলীন কুমার কাতিলকে। দিলীপের মতো তিনিও লোকসভার সদস্য। কর্নাটকের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী ইঙ্গিত দিয়েছেন কাতিলের জায়গায় কর্নাটক অচিরেই নতুন সভাপতি পেতে চলেছে।
বাংলার ভোটে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে দায়িত্বে ছিলেন দলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাশ বিজয়বর্গীয়। ২০২১-এর ২ মে ফল ঘোষণার পর থেকে চুপ মেরে গিয়েছিলেন কৈলাশ। একই আচরণ করছেন কর্নাটকের দায়িত্বে থাকা সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বিএল সন্তোষ। তিনি ভোটের আগে রোজ গণ্ডায় গণ্ডায় টুইট করতেন। গত শনিবারের পর থেকে সব বন্ধ। শুধু প্রধানমন্ত্রী মোদী কংগ্রেসকে শুভেচ্ছা জানিয়ে যে টুইট করেন, সন্তোষ সেটি রি-টুইট করেন সেদিন।
প্রাথমিক ভাবে রাজ্য স্তরে বোম্মাই ও কেন্দ্রীয় স্তরে কর্ণাটকে হারের জন্য প্রশ্নের মুখে বি এল সন্তোষের ভূমিকাও। হিমাচল প্রদেশে যখন বিজেপি হেরেছিল সে সময়ে ভূমিপুত্র জে পি নড্ডার উপরে যাবতীয় দোষ চাপিয়েছিল দল। এ ক্ষেত্রে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ কর্নাটকের ভূমিপুত্র হওয়ায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে তাঁর ভূমিকা। বিজেপি যখন মোদীকে আড়াল করতে ব্যস্ত তখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা বিজেপি’র আর কোনও উপায় নেই। কারণ, ২০১৪ থেকে বিজেপি মোদীময়। আগামী লোকসভা নির্বাচনেও তাঁর নামেই মানুষের কাছে ভোট চাইবে গেরুয়া শিবির। ফলে তাঁকে তো এই মুহূর্তে আড়াল করতে হবেই!